`
ভ্রমণ:

ঐতিহাসিক পীর-সুফী: জানার শেষ নেই

  • Views: 3270
  • Share:
জুলাই ৫, ২০২১ ২৩:৫৪ Asia/Dhaka

আতাউর রহমান :: এদেশখানি পীর-আউলীয়ার দেশ। সেকারণেই পীর-সূফী-ওলী-দরবেশ’র মাজার বা দরগাহকে ঘিরে ‘ওরশ’ উদযাপিত হয়। এই ‘ওরশ’ শব্দের পরিবর্তে কোথাও ‘ইছালে ছওয়াব’ (আত্মার প্রতি ছওয়াব পৌঁছানো) ব্যবহৃত হয়। এসব ‘ওরশে’র আয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যবহার হয় এবং হাজার হাজার মানুষেরও সমাগম ঘটে। এ জাতীয় দিন উদযাপনের লক্ষে চলে নানা আয়োজন। কেউ করে কোরআন খানি, কেউ করে জিকির, কেউ করে নাচ-গান, আর কেউ করে সাদকা দান। ভক্তরা কেন এসব করে, কী স্বাদ পায় তাতে?  দীর্ঘদিনের প্রশ্ন ছিল মনের মাঝে। তাই অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল- মাজার জিয়ারতে যাব।

নির্ধারিত দিনটা ছিল ২৩ আগস্ট ২০১২ইং বৃহস্পতিবার;  ঈদুল ফেতর পরবর্তী মাজার জিয়ারতের সিদ্ধান্ত হয় লায়ন্স ক্লাব অব পঞ্চখণ্ডের সদস্যদের মাঝে। এ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়। অবশেষে  সুযোগ ছাড়িনি। উদ্দেশ্য জিয়ারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। জিয়ারত অর্থ মোলাকাত বা সাক্ষাৎ। আর এ যাত্রায় এই মোলাকাতের শেষ গন্তব্য কেল্লা শহীদের মাজার। যেতে হবে তিতাস নদী তীরবর্তী আখাউড়ার খড়মপুর গ্রামে। সেখানে ঘুমিয়ে আছেন কেল্লা শহীদ। সফর ছিল একদিনের। পথিমধ্যে বেশ ক’টি মাজার জিয়ারত করা ইচ্ছা। তন্মধ্যে  হয়রত সৈয়দ ইয়াকুব শাহ (র.), হযরত শাহ কোয়াছিম উদ্দিন জীবন জ্যুাতি(র:), হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র.), মোড়ারবন্দ দরগাহ শরীফ, হযরত সৈয়দ শাহ গদাহাসান(র:), ফতেহ গাজী(র:) বাগদাদী’র মাজারও এ সাক্ষাৎ-সফরের আওতাভুক্ত। তাই পীর-সুফীগণ’র বিষয়টি সঙ্গত কারণেই আলোচনায় চলে আসে। 

পীর-সুফী’র পরিচয়: পীর’ ফার্সি শব্দ। প্রবীণ, জ্ঞানী, পরিপক্ক, অভিজ্ঞসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয় প্রদানে ‘পীর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর ব্যবহারিক অর্থে ইসলামের নিগৃঢ় তত্ত্বে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিই পীর।  আরবী ভাষায় ‘পীর’ শব্দের পরিবর্তে ‘সুফী’ ব্যবহৃত হয়। এই পীর-সুফীগণ, ভক্তদের আধ্যাতিক গুরু। কারণ, দেহকে বলিষ্ট রাখার জন্য যেমনি খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি আত্মাকে সজীব রাখার জন্য আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন হয়। পীর-সুফীগণ সেসব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সুফীগন নিজের আমিত্বকে বিলীয়ে দিয়ে বিশ্ব পালকের সান্নিধ্য লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্থায়ীত্ব-অমরত্ব লাভ করেন। 

এ পথ কঠোর সাধনার পথ, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথ। আর এসবের মূল পথ প্রদর্শক হলেন মহান আল্লাহ তা’লা। শয়তানের ধোঁকাবাজি এবং ষড়রিপুর (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) যন্ত্রণায় জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত না করে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য দিক নির্দেশনা দেন পীরে কামেল। পীরে কামেল আত্মাশুদ্ধির চিকিৎসক। মাজারগুলো ভ্রমণ করতে গিয়ে এসব মর্মকথা বারংবার মনমন্দিরে ধ্বনিত হয়েছে। জিয়ারতকালেও দেখেছি, সকল মাজারে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের মিলন মেলা। মানুষ কেন জানি সান্নিধ্য চায়; প্রেম ও ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ থাকতে চায়। এসব মাজারে যারা যাওয়া-আসা করেন তাদের ধারণা, এসব জায়গায় নাকি রূহানি জ্যোতির সন্ধান ও জীবনের ক্লেশ মুক্তির ইশারা পাওযা যায়। 

মূলত: এ ঐতিহাসিক সফরের উদ্যোক্তা ছিলেন মরহুম লায়ন লুৎফুর রহমান আজিজ উরপে পীর ভাই(বাড়ি সুপাতলা) ও লায়ন আফসার ভাই। আর গাড়ি আয়োজন করার দায়িত্বে ছিলেন লায়ন আব্দুল কুদ্দুছ এম.জে.এফ। ভ্রমণ ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন  ক্লাব ট্রেজারার লায়ন আব্দুল আহাদ। এছাড়াও সফর সাথী ছিলেন লায়ন আরবাব হোসেন খান, লায়ন ছিদ্দিক আহমদ, লায়ন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালেক, লায়ন ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক ও এশিয়া ছিন্নমূল মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সভাপতি শাহ আলম। মোট দশ জনের দল। যথারীতি পূর্ব প্রস্তুতির পর নির্ধারিত ২৩ আগস্ট ২০১২ইং বৃহস্পতিবার; সকাল ৭: ৩০ মিনিট। একটি হাইয়েস গাড়ি নিয়ে আমরা বিয়ানীীবাজার থেকে বড়লেখা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম।  

এক || হযরত সৈয়দ ইয়াকুব শাহ (র.): 
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৈপরীত আবহাওয়া। উদ্দেশ্য যেখানে জিয়ারত, সেখানে থেমে যাওয়ারও সুযোগ নেই। গাড়ি ছাড়ল ড্র্রাইভার বড়লেখার দিকে। ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর আমরা বড়লেখার রথউলী হয়ে পৌঁছে যাই হযরত সৈয়দ ইয়াকুব শাহ (র:) মাজারে। এ মাজার কচুকাটার মোকাম নামে পরিচিত। তখন ঘড়িতে সকাল ৮: ৪০ মিনিট। মোকামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মাধব খাল। খালের তেমন যৌবন নেই। গাছাগাছালি ও ঝুপডালের আড়ালে মাধব খালখানি যেন আরাধনায় মত্ত।  নিস্তব্দ এখানকার পরিবেশ। গিয়ে দেখলাম তিন মহিলা পায়চারী করছে। পাশে রান্নাঘরে একাধিক চুলা রাখা আছে। এই ঘরে এক সনাতন ধর্মে বৃদ্ধ এক লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে মাংস কাটাকাটি করছেন। রান্নার আয়োজন চলছে। মানস করে এসেছেন চা-বাগান থেকে। আসার কারণ জানতে গিয়ে বৃদ্ধ’র জবাব, পরিবারিক কলহ লেগে আছে। ওলী বাবার পরশে মুক্তি পেতে চান তারা। আমরা ওজু সম্পাদন করে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজারের ভিতর ঢুকে গেলাম। টিন-চালা ঘর বিশিষ্ট এ মাজার। ঘরের ভেতরে অন্য রকম সুবাতাস প্রবাহিত। এদিকে বৃষ্টি কমে এসেছে। জিয়ারত শেষে মাজারের বাহিরে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করে স্মৃতি সংরক্ষণে মাজার সংলগ্ন এলাকার কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম। অতপর গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু হয় হযরত শাহ জিবন জ্যুাতি (র.)’র মাজারের উদ্দেশ্যে। 
   
দুই || হযরত শাহ কোয়াছিম উদ্দিন জিবন জ্যুাতি (র.): 
এখন গাড়ি চলেছে জুড়ির দিকে। পথিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালেক পাঁচ মিনিটের বিরতির জন্য গাড়ি থামিয়ে নিলেন। জাঙ্গিরাই নামক স্থানে নেমে পাশের দোকানে কি যেন রেখে এলেন। তারপর জুড়ি পৌঁছে আমরা ডানদিকে পোস্ট অফিস রোড দিয়ে ঢুকে পড়লাম। সামনে কামিনীগঞ্জ বাজার। আমরা চলেছি ফুলতলা সড়ক দিকে। রতুনা চা বাগান অতিক্রম করেই পৌঁছে যাই হযরত শাহ কোয়াছিম উদ্দিন জীবন জ্যুাতি (র:) মাজার এলাকায়। তখন সকাল ৯: ২০ মিনিট। বিশাল টিলা বেষ্টিত এলাকা। সিঁড়ি দিয়ে অনেক উপরে উঠলাম। সেখানে শায়িত আছেন শাহ জীবন জ্যুাতি। তিনিও ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম একজন। তাঁর মাজার জিয়ারত করে কিছু সময় ঘুরলাম। ছবিও ক্যামেরায় নিলাম। কিন্তু এ মাজার সম্পর্কে কোন কাহিনী কিংবা মাজার সংশ্লিষ্ট তথ্য জানার মতো কোন সঠিক লোকের সন্ধান সেখানে পেলাম না। তাই কালক্ষেপন না করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

আবার চড়ে বসলাম গাড়িতে। এখন চলেছি নাগরাজ রাস্থা দিয়ে। এইচ.আর.সি. চা-বাগান অতিক্রম করে বিজয়া সড়ক পথে কুলাউড়া যাব। সকালের নাস্তা সেখানেই সারতে হবে। যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ১০:২০ মিনিট। কুলাউড়া স্টেশন রোডের ইস্টার্ণ রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা সহ  আনুষাঙ্গিক কাজও সম্পাদন হল। ৫০ মিনিট বিরতির পর ১১:১০ মিনিটে কুলাউড়া ছাড়লাম। গন্তব্য এখন মৌলভীবাজারের হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা’র মাজার। আমরা চলেছি পথে পথে। এবার ড্রাইভার ফয়সাল ইসলামপুর এলাকায় হাজি ইকবাল সিএনজি’র কাছে গিয়ে গাড়ি থামাল। গ্যাস কিনতে হবে। সুতরাং আরও ২০ মিনিট পটাৎ। তারপর মোস্তফা রোড দিয়ে মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। 

তিন || হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র.) : 
ঘড়িতে বেলা ১২:১০ মিনিট। আমরা তখন হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা’র মাজার এলাকায়। হযরত শাহজালাল’র অন্যতম সফর সঙ্গী তিনি। তাঁরই স্মৃতি বিজরিত পুণ্যভূমির নাম মৌলভীবাজার। তিনি সিলেট থেকে মৌলভীবাজার এসে প্রথম রাত্রিযাপন করেন হিলালপুর নামক স্থানে। সে সময় এ অঞ্চলটি গহীন জঙ্গল ছিল। তখনকার রাজা ছিলেন চন্দ্র নারায়ন সিংহ। শালীনতা ও প্রথানুসারে ওলী হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে নামাজের জায়গা ও ইবাদতির জন্য অনুমতির আবেদন করেন। কিন্তু রাজা অবজ্ঞা ও অসম্মানপূর্বক ওলীকে বিতাড়িত করেন। মহান ওলী অপমান বোধ নিয়েই গহীন জঙ্গলে চলে যান এবং সেখানে হুজরা স্থাপন করে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। যা বর্তমানে ‘মোস্তফাপুর’ নামে পরিচিত।

এদিকে ওলীকে অসম্মান করার পরপরই এক প্রকাণ্ড মানুষ খেকো বাঘ লোকালয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাঘটি গৃহপালিত পশু এমন কি মানুষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলত। চন্দ্র নারায়নের রাজ্যে দেখা দেয় অশান্তি। আধুনিক অস্ত্র সস্ত্রসহ শিকারী, সৈন্যরা বাঘকে বধ করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রজাদের নিরাপত্তা দানে রাজাও ব্যর্থ হন। একদিন রাজ সিংহাসনে আরোহন করতে গিয়ে রাজা পড়লেন বিপাকে। তিনি অভাক দৃষ্টিতে দেখলেন যে, একটি বিষধর সাপ ফনা তুলে তার সিংহাসন জুড়ে আছে। সাপুড়ে ও সৈন্যরা কেউ-ই সাপকে তাড়াতে পারেনি। তখন রাজ জ্যোতিষীর গণনায় প্রমান হয় যে, রাজা কর্তৃক ওলীকে অসম্মান করায় এ বিপর্যয় নেমে এসেছে। তখন বাধ্য হযে রাজা ওলীর খুঁজে লোক পাঠালেন এবং তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং রাজ্যের অশান্তি ও অশুভ লক্ষণগুলো দূর করতে দরবেশের সহায়তা চাইলেন।

অতঃপর সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) প্রথমে রাজা চন্দ্র নারায়নের সিংহাসনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার উপস্থিতি টের পেয়েই বিষধর সাপ তার ফণা নামিয়ে নিল। সাপটিকে হাতে ধরে তিনি সিংহাসন থেকে বেরিয়ে পড়েন। জঙ্গলের দিকে তার গন্তব্য। এ সময় মানুষখেকো বাঘটি বাধ্য হয়ে পোষা বিড়ালের মতো লেজ নেড়ে নেড়ে তার কাছে হাজির। তিনি তখন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে হাতের বিষধর সাপ দ্বারা বাঘকে চাবুক মেরে মেরে গভীর অরণ্যে চলে যান। রাজ্যের লোকজন এ অলৌকিক কাণ্ড দেখে বিস্মিত হন। তখন থেকেই তাঁকে ‘শের সওয়ার চাবুকমার’ (‘মার’ ফারসী শব্দ; যার অর্থ সর্প বা সাপ) উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর সেই সময় সেখানকার লোকজন দলে দলে ইসলাম কবুল করতে থাকেন।

পরে রাজা চন্দ্র নারায়ন ওলীর বশ্যতা স্বীকার করে রাজ্য এলাকার ভূ-সম্পত্তি দানপূর্বক ওলীর নিকট রাজ্যের ভার অর্পণ করে অন্যত্র চলে যান এবং তার স্বীয় এক পরমা সুন্দরী কন্যাকে সৈযদ শাহ মোস্তফা’র কাছে বিয়ে দেন। বিয়ের পর সে কন্যার নতুন নাম হয় সুলেমা খাতুন। রাজা চলে যান বর্তমান দেওয়াছড়া চা বাগানের উত্তর এলাকায়। তখন থেকেই সৈয়দ শাহ মোস্তফা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। তিনি ছিলেন বোগদাদের অধিবাসী ও বোগদাদে’র হযরত আলী মর্তুজা ও বড়পীর হযরত সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানীর বংশধর। এই শহরের কেন্দ্রস্থলে বেড়ীরপাড়ের দক্ষিণ তীরে তাঁর মাজার অবস্থিত।

আমরা মাজার জিয়ারত শেষ করলাম। তারপর দেখা করলাম দরগা’র মোতাওয়াল্লী’র সাথে। জানতে চাইলাম, এ মাজার সম্পর্কে কোন পুস্তিকা আছে কিনা। তিনি ২০০৯ইং সনে প্রকাশিত ৭২৬তম বার্ষিক ওরুস মোবারকের প্রকাশনা ‘শাহ মোস্তফা স্মারকপত্র’ বাড়িয়ে দিয়ে হাদিয়া বাবত ৫০টাকা চাইলেন। লায়ন ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক মূল্য পরিশোধ করে বললেন, স্যার রাখেন আপনার কাজে লাগবে। এই মাজারের পশ্চিমকোণে ছোট একটি পুকুরে হযরত শাহজালাল (র:) দরগাহ হতে নিয়ে আসা গজার মাছ রয়েছে। এ মাছ দেখতে ও মানস পুরণে অনেকেই মাছের খাবার নিয়ে এখানে আসেন।

২০০৩ সালের ১২ই মে মাজার বিদ্বেষেী কর্তৃক হযরত শাহজালাল (র:) দরগা শরীফের পুকুরে বিষ প্রয়োগে সব গজার মাছ(প্রায় ৭শ) হত্যা করা হয়। পরে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) দরগা পুকুর থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি  হযরত শাহজালাল’র দরগাহের মোতাওয়াল্লী সরে কফুম ইফসুফ আমান উল্ল্যাহ সাহেবের অনুরোধে ২৪টি পূর্ণ গজার মাছ (পথে ১টি মারা যায়) স্থানান্তর ও অবমুক্ত করা হয়।  সিলেট দরগাহ’র বর্তমান গজার মাছগুরি তাদেরই বংশ বিস্তারের ফল। এই মাছগুলো হস্তান্তরের ৪ মাস ১ দিন পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের ১২ মে হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) দরগা পুকুরেও বিষ প্রয়োগ করে ২৬২টি মাছ দুষ্কৃতিকারীরা হত্যা করে। হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র:) তাঁর ওফাত বা মৃত্যু দিবস ১লা মাঘ। এদিন ওরশ মোবারক উদযাপিত হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, শাহ মোস্তফা (র:) বোগদাদে থাকাকালিন বিয়ে করেন। তাঁর ১ম বিয়ের গর্ভজাত সন্তান শাহ ইসমাইল বোগদাদী (র:) ও তার ভাতিজা সৈয়দ ইয়াছিন শাহ  বাংলাদেশে চলে আসেন হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা’র সন্ধানে। মৌলভীবাজারে এসে তাদের সাক্ষাত হলে তারাও আর বাগদাদ ফিরে যাননি, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফার মাজার সংলগ্ন  শাহ ইসমাইল বোগদাদী (র:) এর মাজার রয়েছে।

শাহ মোস্তফা’র নামানুসারে মৌলভীবাজারে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, ঈদগাহ, সড়ক-হাউজিং ও মোস্তফাপুর গ্রামের নামকরণ’র নিদর্শন রযেছে। আজকের মৌলভীবাজারটি  তাঁরই বংশধর ভাতিজা সৈয়দ ইয়াছিন’র অধ:স্থন মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেন। লর্ড কর্নওয়ালিশের সময় মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মুন্সেফ নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি মনু নদীর উত্তর তীরে কয়েকটি দোকানঘর স্থাপন করে ভোজ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাজারে নৌ ও স্থলপথে প্রতিদিন বেশ লোকসমাগম হত। সেই থেকে প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী’র নামানুসারে ‘মৌলভীবাজার’ নামটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।  
 
চার || সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন ও ১২০ আউলিয়া’র মাজার: 
বেলা ১২:৪৫ মিনিট। আমরা এসেছি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার মুড়ারবন্দ নামক স্থানে। এ জায়গাটি ‘মুড়ারবন্দ দরগাহ শরীফ’ নামে পরিচিত। এখানে শুয়ে আছেন সিলেট বিজেতা হযরত শাহ জালালের অন্যতম সঙ্গী ও সিলেট অভিযানে প্রেরিত মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন।

এছাড়াও এখানে ১২০ জন ওলী-আওলীয়া’র মাজার রয়েছে-এমন কথা জানালেন ঐ দরগার মোতাওয়াল্লী সৈয়দ কবির আহমদ চিশতি। এখানেই যোহরের নামাজ আদায় করলাম। এর পর দরগাহ এলাকায় ঢুকে চোখ ভরে দেখলাম ও জিয়ারত করলাম। বিশাল এলাকা। ঘুরে দেখা গেল, এ দরগা শরীফে ঘুমিয়ে আছেন ‘মুলুক উল উলামা সৈয়দ শাহ ইস্রাইল (র.) বন্দেগী শাহ, সুফী সাধক ও মরমী কবি সৈয়দ শাহ সাঈদ আহম চিশতী (র.), কুতুব উল আউলিয়া সৈয়দ শাহ ইলিয়াস কুদ্দুস (র.)’র মাজারের ভেতরে তাঁর দুই খাস মুরিদ ইসমাইল আজিমাবাদী ও আব্দুল ইমাম আজিমাবাদী (র.), সৈয়দ শাহ দাউদ (র.) ও তার পুত্র সৈয়দ শাহ মহিব উল্লাহ (র.), বন্দেগী শাহ সৈয়দ বায়োজদ (র.), হযরত সৈয়দ সাঈদ আহম চিশতি-সহ নাম না জানা সুফী-আউলিয়াগন। এখানে আমাদের বেশ সময় কেটে যায়। এখানে রয়েছে চিল্লাখানা। যেখানে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র.) ও তাঁর অধ:স্থনরা চিল্লাকুশি করত্রন, এমন জনশ্রুতি আছে।

দেখা গেল, প্রাচীন ইমারতের অংশ বিশেষ। এখানে নাকি ইবাদতখানার ইমারত ছিল। চোখে পড়ে অসংখ্য পাকা করা মাজার। এসব মাজারের কোন নাম ফলক নেই। দেখে মনে হল, দরগাহ শরীফের ভেতরে অনেক সুফী-আউলিয়ার মাজার রয়েছে, যা কালের করালগ্রাসে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এই ‘মুড়ারবন্দ মাজার শরীফ’ কেন্দ্রিক নানারূপ কমিটি রয়েছে। আগন্তুকদের দান খয়রাত সবই এখানে জমা হয়। কিন্তু সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের তেমন সুফল চোখে পড়লো না।  

এই বর্তমান ‘মুড়ারবন্দ দরগাহ শরীফ’র অবস্থান প্রাচীন তরফ রাজ্যের অধীন ছিল। সিলেটের ইতিহাসে বহুল আলোচিত তরফ রাজ্য ১৩০৪ খ্রীস্টাব্দে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন’র নেতৃত্বে বিজিত হয়। তিনি তরপ রাজা আচাক-নারায়নকে পরাভূত করে তরপ রাজ্য জয় করেন। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার তখনকার ‘রাজপুর’ ছিল ত্রিপুরার একটি সামন্ত রাজ্য। এই অভিযানে ১২জন আউলিয়া অংশগ্রহন করেছিলেন বলে তরপ রাজ্য ‘বার আউলিয়ার মুল্লুুক’ বলে খ্যাত। তরপ বিজয়ের পর আউলিয়াগণ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বেড়িয়ে যান। তাদের নিজ নিজ নামে স্ব স্ব স্থানে দরগাহ ও মাজার বিদ্যমান। প্রধান সেনাপতি রয়ে যান মুড়ারবন্দে। আর বাকীরা হলেন: ১. হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (র:) কল্লা শহীদ-আখাউড়া। ২. হযরত শাহ সোলায়মান ফতেহ গাজী বাগদাদী (র:)-শাহজীবাজার, হবিগঞ্জ। ৩. হযরত শাহ তাজ উদ্দিন কোরেশী-চৌকি, নবীগঞ্জ। ৪. হযরত শাহ বদরুদ্দিন-বদরপুর, করিমগঞ্জ। ৫. হযরত শাহ আরেফীন-লাউড়, সুনামগঞ্জ। ৬. হযরত শাহ সুলতান কমরউদ্দিন-মদনপুর, নেত্রকোণা। ৭. হযরত শাহ রুকনউদ্দিন আনসারী-সরাইল, ব্রাম্মণবাড়ীয়া। ৮. হযরত শাহ মাহমুদ-লশ্করপুর, হবিগঞ্জ। ৯. হযরত শাহ গাজী-বিশগাঁও, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ। ১০.হযরত শাহ হাফিজ হাসান শহীদ- লশ্করপুর, হবিগঞ্জ। ১১. হযরত শাহ বদর- চট্টগ্রাম। 

সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন’র জীবনে আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। 
(ক) সিলেট বিজয়ের শেষ পর্যায়ে সিলেটের তৎকালিন রাজা গৌড় গোবিন্দ একটি বৃহৎ ধনুকের জ্যা ছিন্ন করার জন্য হযরত শাহ জালাল’র সমীপে প্রেরণ পূর্বক জানান যে, এ কাজে কেউ সফল হলে তিনি বিনা যুদ্ধে রাজধানী পরিত্যাগ করবেন। শাহাজালাল (র.) তাঁর লোকদের বললেন: যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাজা হয় নাই বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে এই কাজটি করতে। পরে মুসলিম সৈন্যদের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন।

(খ) সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের অলৌকিক ঘটনা সমুহের মধ্যে তাঁর কবর বা মাজার উত্তর-দক্ষিণ হতে পূর্ব-পশ্চিমে মুড়ে যাওয়া নিয়ে বহুর প্রচারণা আছে। ঘটনাটি ছিল এরকম: সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন মৃর্তুর পূর্বে তার ভক্ত সহচরগণকে নসিয়ত করেছিলেন: মৃর্তুর পরে যেন তাঁকে পূর্ব-পশ্চিম করে দাফন করা হয়। তৎকালিন আলীম সমাজের আপত্তির মুখে তাঁর নসিয়ত ভক্তগণ পালন করতে না পারায় ইসলামি নিয়মানুসারে উত্তর-দক্ষিন করেই দাফন করা হয়। দাফন কার্য্য শেষে সকল লোক তাঁর কবর হতে চল্লিশ কদমের ব্যবধান পার হতে না হতেই এক প্রকাণ্ড শব্দ শোনে উপস্থিত লোকজন থমকে গিয়ে দেখতে পান যে, সিপাহসালার কবর মুড়ে গিয়ে পূর্ব-পশ্চিম হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে আউলিয়ার শেষ নসিয়তের কথা স্মরণে নিজেদের ভুল স্বীকারে উপস্থিত আলীমগণ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেই কবরখানি আজও পূর্ব-পশ্চিমমুখি বিদ্যমান। প্রতি বছর বাংলা সনের পৌষ মাসের ৩০ পৌষ হতে ১ ও  ২ মাঘ পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপি এই মুড়ারবন্দ দরগাহ শরীফে ওরশ মোবারক উদযাপিত হয়। 

পাঁচ || হযরত সৈয়দ শাহ গদাহাসান (রা.): 
বেলা ২:৪৫ মিনিট। মাত্র তিন মিনিটের রাস্থা পেরিয়ে গেলেই সৈয়দ শাহ গদাহাসান (র.) মাজার। তিনি ছিলেন একজন কামেল আল্লাহর ওলী। তাঁর অনেক কীর্তি-কাহিনী ও কেরামতের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে আছে। তাঁর কর্মের স্বীকৃতির নিদর্শন ও প্রমাণ মিলে-দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক একটি পরগনা খারিজ করে ‘গদা হাসান নগর’ পরগনা নামকরণের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে মূলতরপ, গদাহাসান নগর পরগনার অন্তর্গত। তিনি বংশ পরস্পরায় প্রাপ্ত একটি অলৌকিক তরবারি শমসের গাজীকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুুমি একদিন খ্যাতিমান হবে’। শমসের গাজী পরবর্তীতে রোশনাবাদের জমিদারি লাভ করেছিলেন। চুনারুঘাট উপজেলার শাহ গদা হাসান (র.) জীবদ্দশায় নরপতি গ্রামে যে বিশাল দীঘি রয়েছে, তা পুন:খনন ও সংস্কার করেছিলেন।  সেই পুকুরের উত্তর পাড়ে বিশাল বটবৃক্ষের নিচে তাঁর মাজার বিদ্যমান। তাঁরই পূর্বসূরী প্রপৌত্র সৈয়দ শাহ কবির (র:) সুতাং নদীর তীরে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন শাহজীবাজার নামে পরিচিত।

ছয় || ফতেহ গাজী (র:) বাগদাদী: 
বেলা ৩:১৫ মিনিট। সড়ক ও জনপদের গ্রামের দৃশ্য ও হাট-বাজার দেখে দেখে পথিমধ্যে পেয়ে যাই হযরত শাহ সুলেমান ফতেহ গাজী (র:) বাগদাদী’র মাজার। তিনি তরপ রাজ্য দখলের ১২ আউলিয়ার অন্যতম একজন বিজিত যোদ্ধা। তিনি হযরত শাহজালাল (র.)’র সফর সঙ্গী ছিলেন। মুড়ারবন্দ তথ্য সংগ্রহকালে তাঁর কথা শুনা হয়। তাঁর মাজারটি হবিগঞ্জের শাহজীবাজারে অবস্থিত। মাজারের নিকটে রেলপথ। নেমে যাই সবাই গাড়ি থেকে। ঢুকলাম মাজার এলাকায়, ছুটে চলেছি  মাজারের প্রধান ফটকের দিকে।

চারদেয়ালে আবৃত মাজারখানি। প্রধান ফটকের কাছে যাওয়া মাত্র কানে ভেসে আসল, জিকিরের আওযাজ। তখন মনে হচ্ছিল অসংখ্য লোকজন হয়তো ভেতরে আছে। কিন্তু না! ভেতরে গিয়ে দেখি, ভিন্ন এক চিত্র। বয়সে তরুন এক যুবক চোখ বন্ধ করে বিশাল শব্দে শানে রিসালত পাঠে মগ্ন। তার  কণ্ঠে  ছিল আরাধনার সুর। শোনা গেল এরকম: “লোকে যাকে মরণ বলে/ মরণ তাতো নয়/ চোখ মুজিলে হয় না মরণ/ চিত্ত বদল হয়।” আর শেষের দিকে যুবক শোনাল ভিন্ন কথা। সেটি ছিল অন্য রকম: ‘খোদা তোমায় ডাকতে জানি না/ আমার মনের দু:খের কথা/ কেউ তো শোনে না’। তার আরাধনার ভঙ্গি দেখে মায়া হল। কষ্ট লাগলো। মনে হল আমরা যে ঢুকেছি, টের পায়নি যুবক। তার সুরধ্বনি মাজারের ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়ে বিশাল শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে দিয়েছে। বলা যায় শব্দ দুষণ। তার কারণে আগন্তুকদের পড়াশোনা করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হলো।

যা হোক, মাজার জেয়ারত শেষে বেরিয়ে যাব। প্রধান ফটকের সামনে ঐ যুবক আবার দেয়াল সৃষ্টি করল। মাজারের দেয়ালে চুমু খেতে খেতে সিজদায় পড়ে আছে প্রধান ফটকের ঠিক সামনে। বের হওয়া যাচ্ছে না। এ দৃশ্য দেখে মোটেও ভালো লাগেনি। এটি আবার কোন তরীকা? জানিনে, কী তার উদ্দেশ্য। যা হোক, মহান আল্লাহ-ই তা ভাল জানেন। এ দরগাহ’র মোতাওয়াল্লি এ মাজার সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। কোন তথ্য দিতেও পারেননি। তিনি বসে আছেন, দান খয়রাত গ্রহনের আশায়। তিনি বললেন, মাজারের তথ্য ঢাকায় আছে। আর যেখানে মাজারখানি বর্তমান সেখানে তথ্য নিয়ে কী লাভ? কত লোকজন আসে, দান-খয়রাত করে যায়। এসব প্রশ্ন তো কেউ করে না। বুুঝলাম বেচারার মাজেজা আলাদা। ছবি তুলতেও বারণ করলেন এক যুবক। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ায় নিষেধের কোন স্পষ্ট কোন ব্যাখ্য দিতে পারলেন না। তারপর মাজার সামনে রেখে আমরা দু’টি ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম।

যাকগে, এখানে খাওয়া-দাওয়া করার মতো তেমন সুব্যবস্থাও নেই। দেখা গেল, ঐ মাজারের পাশে টিলা ঘেষা একটি ছোট চায়ের স্টল। সেখানে গিয়ে সবাই মিলে কিছু মুড়ি(খই), চা পান করলাম। সেখানেও ভিড়। মাজারের বাহিরে একদল ‘টাকা দাও-টাকা দাও’ শ্লোগান তাদের কণ্ঠে। তবে ওরা মাজারে আগন্তুকদের ‘বাবা’ বলে ডাকে। একজনকে দান করলেই নিজের বিপদ ডেকে আনবেন? আপনার সর্বস্ব দিয়েও লাইন শেষ করা যাবে না। এ আরেক বৈচিত্র কারবার। ঘড়িতে তখন ৩: ৪০ মিনিট বাজে। এখন শেষ গন্তব্য কেল্লা শহীদ মাজার। সবাই উঠে পড়লাম গাড়িতে। 
 
 সাত || ১৮শ’ শতাব্দীর কেল্লা শহীদ মাজার : 
বেলা ৪:২০ মিনিট। ব্রাম্মণবাড়ীয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুয়া সড়ক ছেড়ে মেইন রোডের দিকে চলেছি আমরা। গন্তব্য আখাউড়ার খড়মপুরের কেল্লা শহীদের মাজার। বেলা ৫:২০ মিনিটে আমরা দেখা পেলাম গন্তব্যস্থলের। প্রতি বৃহস্পতিবারে এখানে ভক্তদের সমাগম হয়, এ কথা জেনেই আমরা ঐ দিনটি জিয়ারতের জন্য বেছে নিয়েছিলাম। তিতাস নদীর তীরে আখাউড়ার খড়মপুরে অবস্থিত হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেয়ুদারাজ (র:) এর দরগাহ। যা কেল্লা শহীদের দরগাহ নামে সমগ্র দেশ ব্যাপি পরিচিত। কথা ছিল এ মাজার জিয়ারতের আগে খাওয়া-দাওয়ার কাজ সম্পন্ন করা। কিন্তু মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে সবাই যেন এ পর্বটির কথা ভুলে গেলাম। মাজার এলাকা লোকে লোকারণ্য। তাই কথা হল, জিয়ারত ও ঘুরাফিরার জন্য এক ঘণ্টা বরাদ্ধ। এরপর সবাই গাড়ির কাছাকাছি এলেই খাওয়া-দাওযা পর্ব সম্পন্ন হবে। কিন্তু না, তাও হলো না।

এদিকে আমি আছি ইতিহাসের সন্ধানে। তবে সঠিক ইতিহাস জানেন এমন কাউকে এখানে পাওযা গেল না। কেল্লা শহীদের কোন তথ্য পুস্তিকাও স্থানীয় লাইব্রেরীতে নেই। আছে কেল্লা শহীদ কেন্দ্রিক ক্যাসেটের ব্যবসা। স্মৃতি ভিডিও সেন্টারের ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এ মাজারের তথ্য ভিত্তিক কোন ক্যাসেট পাওয়া যাবে কি-না? প্রযোজক কমাণ্ডার মো: মোহন মিয়া, সাংবাদিক জেনে একশ’ টাকার বিনিময়ে তিনটি ক্যাসেট হাতে তুলে দিলেন। এগুলোতে গানের কথা। তিনি জানালেন, ইতিহাস নিয়ে নানা কথা আছে। ‘কেল্লা বাবা সব জানে’ ও ‘ফুলে ফুলে কেল্লা’ নামক ক্যাসেট দু’টিতে আরাধনা আছে, কিন্তু তেমন কোন তথ্য নেই। কেল্লা শহীদের দরগাহ সম্পর্কে ১৮শ’ শতাব্দী হতে প্রচলিত জনশ্রুতি আছে এরকম, যেখানে মাজার অবস্থিত; সেখানকার নাম খড়মপুর। সে সময় এ গ্রামে ছিল জেলে সম্প্রদায়ের বাস। তারা তিতাস নদীতে মাছ ধরত। একদিন চৈতন দাস ও তার সাথীরা ঐ নদীতে মাছ ধরার সময় হঠাৎ তাদের জালে একটি খণ্ডিত শির(কল্লা/মাথা) আটকা পড়ে যায়। খণ্ডিত শির দেখে জেলেরা ভীতস্থ হয়ে পড়ে। খণ্ডিত শির উঠাতে গেলে আল্লাহর কুদরতে খণ্ডিত শির আওয়াজ দিয়ে বলতে থাকে “একজন আস্তিকের সাথে আরেক নাস্তিকের কখনো মিল হতে পারে না।” জেলেরা আরো ভড়কে যায়। তারা কী করণীয় সে বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে খণ্ডিত মস্তকের আওয়াজ এলো- কলেমা পড়; মুসলমান হও।

অবশেষে তারা কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে কলেমা পাঠ করে চৈতন দাস ও তার সাথীরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যায়। পরে মস্তকের নির্দেশ মোতাবেক ও ইসলামী বিধানমতে খড়মপুর কবরস্থানে 'খণ্ডিত কল্লা’ দাফন করা হয়। তখনই ধর্মান্তরিত জেলেদের নাম হয় শাহবলা, শাহলো, শাহজাদা, শাহগোরা ও শাহরওশন। তারাই এ দরগাহের আদিম বংশধর। এই দরগাহের খ্যাতি ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকেই শাহ পীর সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ওরফে 'কেল্লা শহীদে'র পবিত্র মাজার শরীফ নামে পরিচিতি লাভ করে। ২৬০ একর জমির উপর এই দরগা শরীফ। এ জায়গা নাকি দান করেছিলেন তৎকালীন আগরতলা রাজ্যের মহারাজা। ঐতিহাসিকগণের ধারণা, হযরত শাহ জালাল আওলিয়া (র:) সফর সঙ্গী ৩৬০ জনের অন্যতম ছিলেন হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ। তরপ রাজ্যের রাজা আচক নারায়নের সাথে হযরত শাহজালাল’র প্রধান সেনাপতি হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন যে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, সে যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ শহীদ হন এবং তার মস্তক তিতাস নদীর স্রোতে ভেসে আসে খড়মপুরে। আর তাঁর বাকি দেহের অংশ সিলেট দরগাহর পশ্চিমের দিকে শায়িত আছে। প্রতি বছর বাংলা সনের ২৬শে শ্রাবন কেল্লা শহীদের দরগাহে ওরশ হয়। এ ওরশে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। 

আমরা যখন গাড়ীর পাশাপাশি একত্রিত হলাম তখন বাজে সন্ধ্যা ৭:২০ মিনিট। সিদ্ধান্ত হলো- গাড়ি ছাড়ার। বাড়ী ফেরার পথে খাওয়া-ধাওয়া হবে। কারণ, ঘুরাফেরার ফাঁকে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা কম হয়নি। আমি(লেখক) ও আফসার ভাই ছিলাম একসাথে। আমরাও দু’টি করে কলা গলদকরণ করলাম। ঘুরতে গিয়ে চোখে দেখা দিল ভাসমান হোটেল। দেখে খাওয়ার ইচ্ছেও হল; কিন্তু সাথীদের রেখে এ কাজটি করা ঠিক হবে না বিধায় তা আর করা হল না।

পেটের ক্ষুধা নিয়েই বাড়িমুখি যাত্রা শুরু করলাম। পথে গ্যাস নিতে গিয়ে একবার গাড়ি বিরতি হয়। এ সুযোগে লায়ন আব্দুল কুদ্দুছ সাহেব শশা দিয়ে সবাইকে এক দফা আপ্যায়ন করালেন। গন্তব্য হোটেল আল-আমীন-এর দিকে। সেখানে খাওয়া-ধাওয়ার কাজ সম্পন্ন হবে। সেখানে পৌঁছলাম রাত ৯টায়। অবশেষে পেটের ক্ষিধে নিবারণ হল। তারপর আর পথে থামা হয়নি। সড়ক পথে সিলেট হয়ে রাত ১২:৪৫ মিনিটে বিয়ানীবাজার পৌরশহরে পৌঁছলাম। এভাবেই একদিনের ভ্রমণে সমাপ্তি ঘটে।

লেখকঃ মাস্টার ট্রেইনার, শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট। Π প্রাক্তন সভাপতিঃ বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব। Πপ্রধান শিক্ষকঃ দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয়।

user
user
Ad
Ad