`

মুখোশের আড়ালে?

  • Views: 19399
  • Share:
মার্চ ৬, ২০২৪ ১১:১১ Asia/Dhaka

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল:: মানবজীবন নাটকীয়তায় ভরপুর। অনিশ্চিত আগামী সব সময় হাতছানি দেয়। সামাজিক অঙ্গনে নিজেকে মেলে ধরার তাগিদে প্রতিনিয়ত নানা ঢঙে অভিনয় করা লাগে। এ যেন এক বিচিত্র কর্ম। সৃষ্টির আদি হতেই মানুষ তার পরিবেশ এবং চারপাশে নিজেকে জানান দেয়ার ব্রতেই মর্যাদা এবং ভূমিকার ভিন্নতায় সময় স্থান কাল পাত্র বেদে মুখোশের আবডালে নিজেকে উপস্থাপিত করার ফিকির আঁটে। যা সত্যিই অবাক লাগে! কেন এমন করতে হবে?

স্বাভাবিক ভাবে কি নিজেকে উপস্থাপন করা যায় না? ভেতর এবং বাইরে যোজন যোজন ফারাক কেন হবে? মানুষ নানা কারণেই মুখোশে আচ্ছাদিত হয় এবং হতে হয়।এসবে যৌক্তিক অনেক প্রেক্ষাপট ও রয়েছে। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে সমাজ সংসারে নানা রূপে নিজেকে আবির্ভাব  করার যে চলমান প্রবণতা তা সত্যিই তামাশার!

মুখোশের প্রচলন এ জমানায় কখন কিভাবে হয়েছে এসবের সঠিক এবং  নির্ভরশীল ইতিহাসের ঘাটতি রয়েছে।তবে বই-পুস্তক ঘেঁটে যতটুকুন বোঝা যায় তাহলো প্রাচীন গ্রীসে ল্যাটিন শব্দ পারসোনা থেকে এর উৎপত্তি। যেখানটায় গ্রীসে এম্ফিথিয়েটারে অভিনেতারা নানা চরিত্র ফুটিয়ে তোলার স্বার্থে মুখোশ ব্যবহার করত। মনস্তত্ত্ব বিদ্যায় কার্ল ইয়ং এর ধারণায় মুখোশ হচ্ছে তাই যা ব্যক্তির সত্যিকারের বাস্তবতা নয়। তবে  সে নিজে এবং অন্যরা তাই ভাবে। এ প্রসঙ্গে রবার্ট জনসনের বক্তব্য হলো মুখোশ  আমাদের  মানসিক আচরণ। মুখোশের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি নানা ভাবে প্রতিয়মান হয়।

গ্রীসের ইলিয়ড ওডিসি রামায়ণ মহাভারতে ফেরদৌসীর শাহনামায় ইরাকের গিলগামেশ জাতীয় দ্রৌপদীতে এসবের বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ সাদীর কাব্যে দামেশক নগরীর  মহামারিতে এবং উনিশ শতকের শেষে জার্মান  চিকিৎসক অস্ত্রোপাচারের সময় সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের নিয়ম চালু করেন।করোনা কালে এসবের ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। এসবের বাইরে ও রুপকার্থে প্রতিনিয়ত  প্রতিক্ষণ এবং পলকে নানা ধরনের মুখোশ দ্বারা  মানুষের অবয়বে পরিবর্তন আনা হয়।এবং কৌতূহলের জায়গাটুকু হলো চলনে বলনে মননে জাগতিক কর্মকান্ডে যখন মানুষ মুখোশ পরে। এসব  ই হাসির খোরাক যোগায়। ভাবায় আসলেই কি আমরা মানুষ?

সর্বত্রই মুখোশের ছড়াছড়ি। বিশ্বায়নের জেরে সোনা মনিদের মুখে স্পাইডারম্যানের মুখোশের গল্প এবং আবদার শুনি। আর সামাজিক জীবনে এসবের সাথেই আমাদের বসবাস। মুখোশের আড়ালে মানুষ তার স্বীয় অবয়ব দেখতে পায় না।ফলত:তার ত্রুটি চোখে পড়ে না। অথবা নিজের ত্রুটি এবং ভুলের পোস্টমর্টেমে বিচারকের ভূমিকায় নিজেকে মূল্যায়ন করে। অথচ উনারাই কিনা অন্যের  ত্রুটি বিশ্লেষণে উকিলের চেহারায় আবির্ভূত হয়। আর এমন কান্ড সাধারণত শিক্ষিত দুনিয়ায় বেশি দেখা যায়।বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানবদেহের রক্তে দূষিত পদার্থের আধিক্য দেখা দেয়।যার কারণে সমাজ  সংসারে ভালো অবস্থানে থেকে ও সত্য মিথ্যার পার্থক্য করতে দ্বিধান্বিত হয়। সম্পর্কের শীতিলতার আশঙ্কায় অনিয়ম এবং অসংলগ্নতায় দায়িত্ব পালনের চেয়ে  নিজেকে গুটিয়ে চলতে বেশি  পছন্দ করে। এমনকি উভয়কূলেই নিজেকে আপনাদের লোক জানান দিতেই পুলক অনুভব করে। অথচ এসব মানুষের চতুরতা ধূর্ততা যে সাধারণের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না  তারা হয়তো তা অনভুব করতে পারে না। যার কারণে মিথ্যা অপবাদের  দায় থেকে ব্যক্তিকে মুক্তি দিলেও যোগসাজস এবং  পিরিতির দায়বদ্ধতায় প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে শত-পা পিছনে থাকতে ই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কেন এসব! বুঝতে কি কিতাবি জ্ঞান লাগবে?

চরিত্র হলো সুযোগের অভাব। সুযোগ না থাকার কারণে  অনেকেই আমরা চরিত্রবান। আসলে কি তাই? সুযোগের অঢেল হাতছানির মুহে নিজেকে কতটুকুন ভালো রাখতে পারছি? ভেবেছি কি কখনো? ডাক্তার প্রকৌশলী শিক্ষক রাজনীতিবিদ এমন কি পেশা অবশিষ্ট রয়েছে যেখানটায় বুকে হাত দিয়ে বলা যাবে আমরা ভালো! শিক্ষকরা আজ নানা রং বর্ণে বিভক্ত। লোভ এবং লাভের আশায় কর্ণকুহরে তালা লাগিয়ে দিব্যি হরেক পদের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। কোচিং বাণিজ্য প্রশ্নপত্র ফাঁস যৌন হয়রানি তহবিল তছরুপ নাম্বার টেম্পারিং স্বজন আদর্শ এবং এলাকা প্রীতিতে গাঁ ভাসিয়ে জাতির কাছে নিজেদের হেয় ভাবে প্রকাশ করছে। চিকিৎসকরা হাসপাতালের চেয়ে ডেরায়  থাকতে পছন্দ করে। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা অস্ত্রোপাচার এবং  ঔষধ কোম্পানির কমিশন ভুগীতে  জড়িয়ে কি বার্তা দিচ্ছে?প্রকৌশলীরা কি এসবে কম যায়? মুখোশের আড়ালে প্রায়শ:ই স্থাপনা এবং অবকাঠামো পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতি দলবাজি এবং ডিগবাজি তে ভরপুর। যেখানটায় তৃণমূলের চেয়ারম্যান মহোদয়েরা  সর্বসাকুল্যে  মাইনে পায় হাজার দশেক - কি আশায় এবং নেশায় জায়গা জমি বিক্রি ধার-দেনা অনুদান নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার  এত বিনিয়োগ। পাঁচ বছরে সহজ তরিকায় আসল উঠানো ই দায়। তবে কেন? এসব মুখোশের আড়ালে কিসের ইংগিত?

সমাজ সভ্যতায় চলতে ফিরতে নানাভাবে নানা জনের সাথে উঠবস করা লাগে। ভালো অবস্থানে চলে গিয়ে অতীত ভুলার মুখোশ কেন জানি  আমাদেরকে দিব্যি দ্বিচারিতায় আবিষ্ট করে। জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো- এ শক্তি ই মানুষের আকাঙ্ক্ষা হওয়ার কথা। কার্যত আমরা কি দেখি? শিক্ষিতজনের বাবা-মায়েরা যখন প্রবীণ নিবাসে আস্তানা  পোঁতে, তখন মানব জন্ম অসার মনে হয়। মূল কে অস্বীকার করে বড় হওয়ার মাঝে যৌক্তিক  তৃপ্তি নেই। সর্বত্র হাহাকার।বাবার পেশা কে উপস্থাপনে নিজের মাঝে অনীহা এবং সংকোচ কতটুকুন শোভনীয়? গ্রামীণ জনপদের মেধাবী  শিক্ষার্থী চাকুরী জীবনের শুরুতে ভূমি অফিসের ছোট কর্মচারী থেকে যখন শিক্ষা  ক্যাডারে চলে আসে- তখন অতীত ভুলে যায়। নিজের মেধা এবং যোগ্যতা প্রমাণে  প্রাথমিকের শিক্ষকের জ্ঞান-গরীমাকে তুচ্ছ করতে আলবাৎ দ্বিধান্বিত হয় না।এমন মুখোশে আজ সর্বত্র  ছেয়ে গেছে। যা নিয়ত চারপাশে মঞ্চস্থ হচ্ছে।হায়রে সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী!কৃষকের ঘামের সাথে আর কত বেইমানি এবং  রসিকতা!

ইদানিং নেট দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখোশের আধিক্য  পরিলক্ষিত হয়। তেলবাজি লাভের লোভ নিজেকে ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা এবং আপোষকামিতার বন্যা বয়ে  যায়।এ মাধ্যম যেন মুখোশের ধারণায় নতুন পালক সংযোজন করেছে।পরিচিত অপরিচিত জনকে লাইক কমেন্ট ভিউ  এসব রোজকার কারবার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুর অপরিচিত আত্মীয়স্বজনের সুখ কষ্টে ও দূর থেকে শামিল হচ্ছে।ফেসবুকে অমুকের পক্ষ থেকে তমুক ভাইয়ের শুভেচ্ছা হরহামেশাই  দেখা যাচ্ছে। এ জগতে অনেকে ই নানাভাবে প্রতারণা এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তিশা মুশতাকের অসম কাহিনীর অযাচিত  চর্চা এখানটায়  দেখা যায়। এসবের স্বরূপ এবং মুখোশের আড়ালে দীণতা এবং দৈণ্যতা উঁকি দিচ্ছে। প্রজন্মের কাছে আমরা কি বার্তা দিচ্ছি?

পচন সর্বত্র। সবাই মুখোশের আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে। নগরে আগুন লাগলে কি দেবালয় রক্ষা পাবে? সবাই যদি মুখোশের আড়ালে নিয়ত অভিনয়  করতে থাকি তাহলে স্বকীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অর্জিত গৌরব ধূলোয় মিশে যাবে।হাহাকার  করতে হবে সবাইকে। এমন সমাজ কি আমরা চাই? মুখোশের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়তো সাময়িক তৃপ্তি অনুভূত হচ্ছে, কিন্তু  এর প্রভাব রেশ অনেক বেশি প্রলম্বিত। সম্মিলিতভাবে মুখোশের মোহ থেকে বের হতে না পারলে ব্যক্তিগতভাবে কারো পরাজয় হবে না।সামষ্টিকভাবে সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে পয়গামকে আমরা এন্টারটেইন করছি সহসাই ফলভোগের প্রায়শ্চিত্ত ললাটে হাজির হবে।অন্যায় অনিয়ম তোষণের মসনদে যারা বাঁধা হয়ে প্রাচীর তৈরি করছে, সাময়িকভাবে বিহবল এবং বিমর্ষ হলেও ব্যক্তিক জেগে ওঠা ক্ষণিকের তাড়না মাত্র।

সময় এখন মুখোশের স্বরুপ  উন্মোচনের। সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। নিজের এবং আগতদের সামনে ব্যক্তিত্ব জানান দিন। কাউকে গুয়েবলেসীয় কায়দায় অপবাদ প্রবণতার মাঝে সবার পরাজয়ের বীজ অঙ্করিত হয়। এসবের ডালপালা গজানোর খেসারত সবার জন্য অমঙ্গলের।স্বাস্থ্য সুরক্ষা মহামারি থেকে বাঁচতে অভিনয়ের মঞ্চে এসবের ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকুক, এমনটাই প্রত্যাশা।জাগতিক লাভ এবং লোভের মুখোশের খোলস উন্মোচিত হয়ে সুস্থ সুন্দর  এবং স্বাভাবিক সমাজ কাঠামোর উপস্থিতি ঘটুক। আগামী প্রজন্মের কাছে এটুকুন আশা করাই  যায়।

লেখকঃ  অধ্যাপক , সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: alioakkas@gmail.com
(শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব কর্তৃক কথন ৪ এ প্রকাশিত। কৃতজ্ঞতা শাবি প্রেসক্লাব)

user
user
Ad
Ad