`

স্বর্গের প্রজাপতি!

  • Views: 5077
  • Share:
জুলাই ২৬, ২০২৩ ০৯:১৭ Asia/Dhaka

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল:: গত রবিবার থেকে মনটা ভালো নেই। সারাক্ষণ শূন্যতা  এবং অস্থিরতা মননে মানসে ঝাকি দিচ্ছে। এ পৃথিবী নশ্বর। চিরদিন কারো পক্ষেই থাকা অসম্ভব। মায়ার জাল ছিড়ে পরপারে পাড়ি দেওয়াই যেন শেষ গন্তব্য! ২০১৭ এর অক্টোবরে জন্ম নেয়া আইমান আজ আমাদের মাঝে নেই। জন্মের পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থেকে নীড়ে ফেরা সোনামণি শারীরিক অক্ষমতার জন্য সারাক্ষণ শুয়ে হামাগুড়ি দিয়েই দিনাতিপাত করতো। তার নজরকাড়া হাসি এবং উপস্থিতি বুঝার অনুভূতি ছিল অসাধারণ। বাবা মায়ের যত্নে লালিত আদরে ধনের বিয়োগ মেনে নেওয়া কঠিন। এ যে এক নির্মম বাস্তবতা!অশান্ত ধরণীর ঝুট-ঝামেলা অস্থিরতা অরাজকতা পংকিলতা এসবে না ভিজে প্রস্তান প্রকারান্তরে প্রশান্তির ও বটে।

সুমন আমার অনুজ। আয়মানের জন্মের পর থেকে রবিবার  বেলা এগারো টা অবধি প্রায় অর্ধযুগ নিদ্রাহীন অবসরবিহীন ব্যক্তিগত আরাম আয়েশের সাথে সারাক্ষণ সমঝোতা করে পুষ্পিত প্রজাপতির সেবা করার যে হিম্মত দেখিয়েছে তা সত্যিই  অসাধারণ।এক পলকের জন্য ও এসবে খেদোক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি। আয়মানের মায়ের স্বার্থহীন আত্মত্যাগ সময়-অসময়ে দৌড়াদৌড়ি নিবিড় পর্যবেক্ষণ তাদের চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত আমাকে প্রায়শই ভাবতো।তার বেড়ে ওঠা এবং ভবিষ্যৎ দেখভাল কে ঘিরে কিভাবে সামনের সময় পাড়ি দিবে উভয়ের চাহনি এবং চলাফেরায় অনুভূত হতো।তবে একবারের জন্যেও এসবে আক্ষেপ বা অভিযোগ শোনিনি।

মাসুম শিশুর প্রস্থান মেনে নেয়াটা অনেক কষ্টের। বাবা মায়ের জন্য তা কল্পনাতীত।পৃথিবীর যিনি মালিক চাইলেই কি তার পরিকল্পনার বাইরে ভাবা যায়? জাগতিক জীবনে যদিও আমরা নানাপদের প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা নিয়ে সামনের দিনলিপি সুখকর করার প্রত্যয় পোষণ করি। এসব কেবলই নিরর্থক ভাবনা!কারণ প্রভু যে মহাপরিকল্পনাকারী। আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এসবে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা ই মানব মনে প্রশান্তি ও স্বস্থির হিন্দোল বহমান করতে প্রেষণা যোগায়।পবিত্র কোরআনে এসেছে নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করেন এবং ধৈর্য্য ধারণ করে, আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।(সূরা ইউসুফ:৯০) সবাই সন্তানের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়। স্বয়ং মহানবী (সাঃ) শিশু পুত্র ইব্রাহিমের বিয়োগে মর্মাহত এবং বিহবল হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন।

সন্তান সন্ততি আল্লাহর অপার দয়া ও দান। এখানে  কারো হাত নেই। এসব  মানব জীবনে পূর্ণতা আনয়নে উপাদেয়  হিসেবে কাজ করে। ফলমূলের মাঝেই জগতের সৌন্দর্য। আল্লাহ বলেন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। (সূরা কাহাফ:৪৪) আল্লাহর সানুগ্রহ ই এ পথের মূল নিয়ামক। কোরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে তিনি যাকে ইচ্ছে কন্যা সন্তান দান করেন।যাকে ইচ্ছে পুত্র সন্তান দেন।অথবা পুত্র ও কন্যা সন্তান উভয়ই দেন। এবং যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন। তিনি  সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। (সুরা শুরা:৪৯-৫০)

নাট্যমঞ্চে চিরদিন থাকা যাবে না। সবাইকেই পরপারে যেতে হবে। তার এ প্রস্থানে সে অনন্তলোকে সুখে থাকবে। জান্নাত প্রাপ্তির সংবাদ হাদিস এবং  কুরআনে এসেছে। এমনকি বেহেস্তে শিশু খাদেমের স্বীকৃতি এ বিয়োগের মাঝেও আনন্দ এবং স্বস্তি দেয়।মা বাবার এতদিনের পরিশ্রম ভালোবাসা আহ্লাদ যাকে ঘিরে সে চলে গেলেও তার কাছ থেকে অনেক অনেক ভালো পয়গাম এবং পুরস্কারের আশায় দুজন বুক বেঁধে ধৈর্য্য ধারণের মাঝে সুখ  অনুভব করতে পারে।হযরত আবু হুরায়রা (রা:)বলেন আমি নবী (সা:) কে বলতে শুনেছি ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী জান্নাতের প্রজাপতির মত।তারা যখন বাবা অথবা বাবা মায়ের উভয়ের সঙ্গে মিলিত হবে তখন সে পরিধেয় কাপড় কিংবা হাত ধরবে।তারপর সেই কাপড় বা হাত আর ছাড়বে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ  তাকে মা-বাবা সহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (মুসলিম) তিরমিজি শরিফে বর্ণিত ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন আপনার বান্দা এই বিপদেও ধৈর্য্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করছে। এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে। তখন আল্লাহ বলেন তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে দাও এবং বাইতুল হামদ নামকরণ কর।

এসব শিশুরা বেহেস্তের শোভা।ইব্রাহিম(আ:)তাদের সাথে খেলাধুলা করবেন।এবং এরা জান্নাতের শিশু খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।এতো পরম সৌভাগ্য!এ মওকা কয়জনের ভাগ্যে জোটে?এসবে বিচলিত না হয়ে প্রভুর প্রশংসা এবং ধৈর্য্য ধারণের মাঝেই ভবিষ্যৎ প্রশান্তির নিশ্চিত আকাঙ্ক্ষা করা যেতে পারে। মৃত্যু সবসময়ই বেদনার।সে হাঁটাচলা করতে পারত না সঙ্গত কারণেই বাবা মায়ের যত্ন নজরদারী এবং যাবতীয় অভাব অভিযোগ মেটাতে অন্য স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে হাজার গুণ শ্রম এবং মনযোগ বেশি দিতে হয়েছে।ফলতঃ স্নেহ ভালোবাসা এবং অনুভূতিটা ও অনেক বেশি। জাগতিক বাস্তবতায় আজ আমরা শোকে পাথর।এ বিদায় ক্ষুরে ক্ষুরে আমাকেও ভাবাচ্ছে। তার চাহনি এবং হাসি ভুলতে পারছিনা।

আয়মান সৌভাগ্যবান। অল্প সময়ের নোটিশে তার নিকটজন সবাই সমবেত হয়েছেন।বিশেষত তার খালা যিনি কিনা ফরিদপুর থেকে এসে হাজির হয়েছেন। শিশু মৃত্যুতে এতটা বিচলিত সাধারনত আমরা হতে দেখিনা।তবে সে আমাদের মনে দাগ কেটেছে।কর্তব্য কারণে জামালপুর থেকে সংবাদ শুনে ভাবছিলাম যথাসময়ে পৌঁছাতে পারব কি?মাবুদের দয়ায় জান্নাতের শিশু খাদেমের জানাজায় অংশ নিতে পেরে তৃপ্তি অনুভব করছি। ঢাকা থেকে তার দুই চাচার কর্তব্যকর্ম ফেলে নীড়ের টানে ছোটে এসেছেন  যা বন্ধনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।বাবা-মা সৌভাগ্যবান।এমন শিশু জন্ম দানের মাঝেই প্রভুর নানা উপঢৌকনের প্রতিশ্রুতি।যা জেনে ধৈর্য্য ধরে স্রস্টার প্রশংসা করতে পারবে।আইমানের হাসিমুখে বিদায় এবং বেদনার সাগরে নিমজ্জিত হওয়া দুনিয়ায়  স্বাভাবিক নিয়তি।ভালো লাগছে ঘুনে ধরা এ সমাজের পাপ রাহাজানি জালিয়াতি কৃত্রিমতা অসংগতি স্বার্থপরতা এসব স্পর্শ করার আগেই নিষ্পাপ প্রজাপতি বেশে  প্রস্থান। যা কিনা ভাবলেই কষ্ট ভুলে যেতে সহায়ক শক্তি হিসেবে রসদ যোগায়। আয়মান আমাদের আশীর্বাদ।

লেখকঃ ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল
অধ্যাপক , সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 
ইমেইল: alioakkas@gmail.com

user
user
Ad
Ad