`

"আমার শিক্ষক  "

আজ মহান শিক্ষক দিবস
  • Views: 721
  • Share:
অক্টোবার ৫, ২০২১ ১২:৪৭ Asia/Dhaka

মো: জহির উদ্দিন :: ৫-ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক  শিক্ষক দিবসের সকল আনুষ্ঠানিকতা কোবিড-19-এর কারণেই অন্যান দিবসের মতই অনাড়ম্বরতার মধ্য দিয়েই  পবিভিন্ন মিডিয়া, অনলাইন ও ইনডোরে এবারও পালিত হচ্ছে। পেশাগত কারণেই অনলাইনে আমারও এই ক্ষুদ্র সংযুক্তি ।

প্লেটো যেখানে তার "দ্যা রিপাবলিক "গ্রন্থে বলেন একটি রাষ্ট্র তার সকল নাগরিককে শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তুলতে যদি না পারে, তবে, সে রাষ্ট্র  আর কি করলো বা নাই করলো, তাতে কিছুই যায় আসে না । আমরা জানি, শত জানি তারপরও প্লেটোর হাজার বছরের পূর্বের কথায় আমরা বুঝতে পারি যে, জ্ঞানী -গুণী ও মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা কতটা বেশি প্রয়োজন এবং যা বাস্তবায়ন করেন মূলত একটি রাষ্ট্রের শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষক এমন একটি মহান শব্দ যা সকল শব্দের  শীর্ষে । যার মহাত্মের জন্য যুগে যুগে যারা মহাজ্ঞানী হয়েছেন তাদেরকে উপাধি দেয়ার জন্য শিক্ষক অভিধাটিই বেচে নেয়া হয়। 

প্রথম শিক্ষক উপাধি পান এরিস্টটল এবং পরে দার্শনিক আল ফারাবী । শিক্ষক হচ্ছেন গুরু আর বাকী সবাই শিষ্য এবং শিষ্যের উপর তার  প্রভাব থাকে জীবনভর। কাজেই বুঝা যাচ্ছে যে, একজন শিক্ষক কেমন হওয়া দরকার এবং তাঁকে কেমন করে তৈরি করা প্রয়োজন, ইত্যাদি।
 
আমরা প্রত্যেককেই কোনো না কোনো শিক্ষকের স্পর্শে বেরিয়ে আসতে হয়। কথায় বলে না, যেমন  গুরু তেমন শিষ্য। প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের  শিষ্য আর এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর এবং মহাবীর আলেকজান্ডার ছিলেন এরিস্টটলের শিষ্য। মহাবীর আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে বাদশা আলমগীরসহ অনেক জ্ঞানী -মহাজ্ঞানীগণ শিক্ষকের মর্যাদার দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন। সেই শিক্ষক কেমন হবেন তা সংজ্ঞায়  সীমাবদ্ধ করা যাবে না।
 
কিছু উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আমারা অনুধাবন করতে পারি । বিশেষ করে স্কুল জীবনে শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষকের প্রভাব এতোই বেশি থাকে যে, যা স্বল্প লিখনে বিন্যাস করা যাবে না । কোমল মনের শিশুরা মনে করে , এ  জগতে তার শিক্ষকই সবচেয়ে বড় ও জ্ঞানী ব্যক্তি । শিক্ষক যাই শেখান তারা মনে করে এটাই ঠিক এবং তারা তা প্রায় নির্বিচারেই গ্রহণ করে । যেমন,  আমার মেয়ে একদিন বললো, ম্যাডাম আজ শিখিয়েছেন  "ম্যা আই গো টু টয়লেট।

আমি বললাম তার চেয়েও  সুন্দর করে তুমি   বলবে  "ম্যা আই গো টু  ওয়াশরুম। " কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে মানিয়ে নিতে পারলামনা । ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বুঝালো তার ম্যাডাম যা বলেছেন তাই ঠিক।এ ক্ষেত্রে  আমি অন্যটি শেখাতে পারিনি । কাজেই আগে বুঝতে হবে শিক্ষার্থীর উপর শিক্ষকের  কেমন প্রভাব এবং তখনই আমরা যারা আমাদের সন্তানের জন্য শিক্ষক রাখতে চাই বা আমরা যারা শিক্ষক হতে চাই বা যারা শিক্ষক আছি কিংবা যাঁরা শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাই , আমাদের সকলের সমন্বিত উপলব্ধিই হবে শিক্ষকের সংজ্ঞা ও মর্যাদা। ফিনল্যান্ডকে বলা হয় সোনার ছেলে মেয়ে উৎপাদনকারী দেশ।
 
কেননা, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কৃতিত্ব অর্জনকারীদের থেকে বাচাই করে তিন ক্যাটেগরীর শিক্ষক নির্বাচন করেন  এবং  তা   থেকে  প্রথমটিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেন। দ্বিতীয়টি মাধ্যমিককের জন্য এবং তৃতীয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিয়োগ দেন । কাজেই বুঝতে হবে যে একজন শিক্ষক হবেন খুবই পরিকল্পিত একজন  ব্যাক্তি। বুঝতে হবে যে , তিনি কোনো দফ্তরের কোনো  কর্মকর্তা নন, তিনি আপনার স্বপ্নসারথি, আপনার সন্তানের বিনির্মাতা, তিনি শুধু ক্লাসের বই পড়ানোর জন্যই নন, তিনি  হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, পথ প্রদর্শক, দার্শনিক ও-অভিভাবক, মা-বাবা  সবই এবং তখনই গুরু শিষ্যের স্বার্থকতাই শুধু নয়, একটি জাতিকে বিনির্মাণের  মাধ্যমে বদলে দেয়া যায় ।  কাজেই শিক্ষক তার ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে যখন শিক্ষার্থীর স্পর্শে আসেন, তখন মনে করতে হবে যে তিনি পুরো মানুষটিই শিক্ষার্থীর  জন্য একটি মডেল । তাঁর  কথা, বাচনভঙ্গি, চাল-চলন, তাঁর রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, তাঁর নৈতিক ও মানবিক উদারতা সবই তাঁর শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা এবং এর প্রভাব সে সারা জীবন বহন করবে।
 
একজন শিক্ষক আমাদের প্রজন্মের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপস্হাপনের জন্য একটি গল্পের  সারাংশ  উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরতে চাই এজন্য যে,  একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে কতটুকু অনুভুত হওয়া দরকার তারই জন্য । 

অনেক অনেক দিন আগে, একদা একদিন বিলেতের এক রাজা একটি  স্কুলের ক্লাস পরিদর্শনে আসেন । মহান রাজা শ্রেণিকক্ষে ঢুকার সাথে সাথে দেশের রীতি অনুযায়ী  সব শিক্ষার্থীরা মাথার ক্যাপ নামিয়ে অবনত মস্তকে রাজাকে কুর্ণিশ করলো । কিন্তু ক্লাস শিক্ষক মাথার হ্যাঁটটিও নামালেন না, রাজাকে কুর্ণিশও করলেন না ,রাজাকে কেবল স্বাগতম জানালেন। 

শিক্ষার্থীরা দেখলো আর ভাবলো তাদের শিক্ষক রাজার মতই মহান, রাজার সমান। রাজা চলে গেলেন । পরের দিন এই শিক্ষক রাজার দরবারে  
গেলেন, রাজার সাথে দেখা করে ঘটনাটির জন্য  দুঃখ প্রকাশ করতে। তিনি রাজাকে কুর্ণিশ করে বললেন, আপনি আমাদের দেশের মহামান্য রাজা, সকলের উপরে আপনার  স্হান কিন্তু গতদিন আমি ছেলে মেয়েদের সম্মুখে  আপনাকে কুর্নিশ করে বিশেষভাবে কোনো সম্মান জানাতে পারি নি, এজন্য আমি আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে এসেছি। 

রাজা সাথে সাথে তার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষক বললেন, আমি যদি ঐদিন আমার শিক্ষার্থীদের সম্মুখে নত হয়ে আপনাকে  কুর্নিশ করতাম, তবে আমার শিক্ষার্থীরা মনে করতো আমাদের শিক্ষক রাজার মতো বড় নন, তিনি রাজার চেয়ে অনেক ছোট্টো এবং তাদের জীবনে এই ছোট্ট প্রভাবটুকুই পড়তো । তাই আমি আপনাকে কুর্নিশ করতে পারি নি। শুনে রাজা অভিভুত হয়ে সন্তোষ্টি প্রকাশ করে বললেন তাহলে আমার সন্তানেরা সঠিক শিক্ষা পেয়েই বড় হচ্ছে। তার পর রাজা সারা দেশের শিক্ষকদের এক নোটিশে জানিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে কাউকে কুর্নিশ করতে পারবেন না।
 
 কাজেই আমার শিক্ষক হবেন আমার সন্তানের হৃদয়ের উচ্চতর মডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান  জঘন্যতম পারমাণবিক আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েও কেবল শিক্ষাখাতে  সর্বোচ্চ বিনয়োগ করে আজ ঞ্জান বিঞ্জানসহ সকল বিষয়ে দৃ্ষ্টান অর্জনকারী অন্যতম একটি দেশ। অতএব রাষ্ট্রের অন্য  দফতর -অধিদফতরে কেমন কর্মকর্তা নিয়োগ দেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু জাতি গঠনে মানুষ গড়নের জন্য কেমন ব্যক্তিকে শিক্ষক পদে  নিয়োগ দিচ্ছেন তার জন্য অনেক কিছুই আসে যায়।

কেননা একটি জাতির শিক্ষক সমাজ,  যে আদল ও আদর্শের জনবল ও নাগরিক সমাজ  তৈরী  করবেন, একটি দেশের জনগণ সকল বিভাগ থেকে কেবল সেই  মান ও আদর্শের মর্যাদা ও সেবা পাবে । সর্বোপরি বুঝতে হবে মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার  সন্তানেরা এবং এই মহামূল্যবান সম্পদই তারা শিক্ষকের হাতেই তুলে দেন হাজারো স্বপ্ন মুড়িয়ে। আর এ উপলব্ধি একজন শিক্ষকের যেমন থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে গোটা জাতির অভিভাবকদের । আর একজন শিক্ষকের এই উপলব্ধি  থাকলেই তিনি শিক্ষার্থীর মনোজগতে সঠিকভাবে বিচরণ  করতে পারেন  এবং তিনিই তার শিক্ষার্থীর জন্য যথেষ্ট । অথচ এ শিক্ষক সমাজকে  আমাদের দেশে  অতি সাধারণ হিসেবেই গণ্য করে রাখা হয়েছে। আর    আমাদের দেশের সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষাদানের জন্য কি মর্যাদা ও  সহযোগিতা পাচ্ছেন তা আমাদের সকলেরই জানা । কাজেই শেষ  কথা হচ্ছে  আমার সন্তানের প্রেরণা ও চেতনার উৎস যে শিক্ষক, তিনি হবেন মানবিক ও শিক্ষা দরদী বহু গুণে গুণান্বিত একজন মর্যাদাবান মহান মানুষ । আর এই মূল্যবান মানুষটিকে তৈরী  করণের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রের সরকার ও সচেতন সমাজকে । 

লেখক  
জহির উদ্দিন। 
অধ্যক্ষ শাহনিমাত্রা এস এফ ডিগ্রি কলেজ।

user
user
Ad
Ad