`

ইভ্যালিকান্ড ও আমার প্রতিক্রিয়া

  • Views: 478
  • Share:
সেপ্টেম্বার ১৮, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ :: ডেসটিনি ২০০০ নামে একটা মার্কেটিং কোম্পানি এল। সিলেটের শাহজালাল উপশহরে সম্ভবত অফিস খুলল তারা। আমি থাকতাম এই এলাকায়। বিকেলে আড্ডা দিতাম সি ব্লকের একটা একুরিয়ামের দোকানে। একুরিয়ামের বাইরের খোলা জায়গায়ও চেয়ার পেতে বসতাম মাঝেমধ্যে। নিজে থেকে কাউকে ডেকে মজমা বসাতাম না কখনোই। ভালোবেসে অনেক ছোটভাই এসে জড়ো হত এখানটায়। আপ্লুত হতাম আর ভাল সময় কাটাতাম। আমার আড্ডায় নিজ দলের বাইরের অন্যান্য দলের ছেলেরাও আসত। নানান বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক হত।

ডেসটিনির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে আসতেন এখানে। আমাকে বেশ সমীহ করে সম্পর্ক স্থাপন করলেন এই কর্মকর্তারা। তারা দারুণ একটা টোপ দিলেন আমাকে। তারা বললেন তাদের মার্কেটিং কোম্পানির সদস্য হয়ে যেতে। যদ্দূর মনে পড়ে, সাড়ে চারহাজার টাকার প্রোডাক্ট কিনে তাদের সদস্য হতে হত। তাদের সাথে আলাপ করে জানলাম, প্রোডাক্টের একটা তালিকা আছে তাদের কাছে। তারা এও জানালেন, এই প্রোডাক্টের ব্যাপারে আমাকে ভাবতে হবেনা। তারাই এর কেনাকাটার বিলি বন্দোবস্ত করবেন। আমাকে শুধু টাকা দিলেই হবে। প্রোডাক্ট দেখার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য কোনোটাই হবেনা আমার।

আমি সম্মত না হওয়ায় ডেসটিনির বেরাদররা আমাকে বেশ লোভনীয় অফারটা দিলেন। তারা বললেন, আমার কাজ শুধু প্রোডাক্ট কেনা আর আরও দুজনকে এই প্রোডাক্ট কেনানো। ঐ দুইজন প্রোডাক্ট কিনলেই আমার তহবিলে পয়েন্ট জমা হবে। আর যত পয়েন্ট তত টাকা। এই দুইজন আরও চারজনকে সদস্য করবেন৷ চারজন করবেন আরও আটজনকে। এভাবে এই তথাকথিত প্রোডাক্ট কেনার নামে প্রত্যেকটা ব্যক্তি আরও দুইজনকে এই ফাঁদে ফেলতে থাকবে। আর এভাবে নাকি আমার তহবিলে পয়েন্ট বাড়তে থাকবে।

পয়েন্ট বেড়ে বেড়ে সিলভার, গোল্ড, ডায়মন্ড, প্লাটিনাম এরকম নানান উপাধি পাওয়া যাবে। অঢেল টাকা হবে। বাড়ি, গাড়ি সব হবে। ডেসটিনির ভাইয়েরা বললেন, আমার কাছে অনেক ছেলেরা আসে। আমাকে ভক্তি করে। এদেরকে এই টাকা গড়ার মেশিনের চেইনে নিয়ে আসলে অচিরেই আমি  সোনা, রুপা, হীরা, তামা, দস্তা ইত্যাদি হরেকরকম উপাধি পেতে থাকব আর তহবিলে টাকা জমা হতে থাকবে।

পরবর্তীতে সিলেটের চৌহাট্টার মানরু শপিং কমপ্লেক্সে ডেসটিনি তাদের অফিস বসায়। সেখানে চাল ডাল এরকম কিছু প্রোডাক্টও প্রদর্শনের জন্য রাখে গুদাম আকারে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত অনেকেই দেখলাম কোট টাই পরে লোকজনকে হাতে কলমে এই মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বোঝাচ্ছে। গ্রামগঞ্জ থেকে ছেলেরা কোট টাই পরে মানরুর সামনে লাইন দিচ্ছে। কেউ কেউ বেশ কামাই করছে সেটাও বোঝা যায়। তাদের চলন বলন আর পোশাক আশাক সেটার সত্যতা জানান দেয়।

আমি প্রডাক্ট কেনার নামে এই ভাওতাবাজি পছন্দ করতে পারিনি। নিজের সাড়ে চারহাজার টাকা তোলার লোভে আরও দুইটা মানুষকে ট্র‍্যাপে ফেলার মত কাজ করতে কুন্ঠিত হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু দেখিনি। ভালোবেসে আমার কাছে আসা ছোট ভাইদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলার কথা ভাবতেও পারিনি। ডেসটিনির কেউ আমাকে আর বোঝাতে আসেনি।

ডেসটিনির অধিকর্তারা প্রতারণা আর অর্থ পাচারের দায়ে শ্রীঘরে গেলেন। তার কিছুদিন পরে আবার শুনলাম মার্কেটিং দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছে যুবক নামের এক কোম্পানি। মানুষ জমিজমা আর গাছপালায় নাকি দেদারসে বিনিয়োগ করছেন তাদের মাধ্যমে। এলাহী ব্যাপার। যুবক কিভাবে কাজ করে সেটা আমি খুঁজে দেখিনি। আমার মধ্যে কোনো আগ্রহই তৈরি করতে পারেনি যুবক। আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ডেসটিনির কথা।

কিছুদিন পরে সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারলাম যুবকে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ আর হাহুতাশ। শুনলাম, ঐ কোম্পানির পালেরগোদাদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। বেশ কিছুদিন ফলোআপ সংবাদে জানলাম, ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা তাদের বিনিয়োগ করা কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত পাননি। তারপর সব চুপচাপ।

যুবক কান্ড শিথিল আর স্থিমিত হয়ে যাওয়ার পর আমার পরিবারের এক নিকটজন আমাকে উৎসাহ দিলেন সোনার কারবারে বিনিয়োগ করতে। ইউনিপে টু ইউ নামে নাকি এক সোনার কারবারের মার্কেটিং কোম্পানি এসেছে। তিনি জানালেন, নানান প্রোডাক্ট আছে তাদের। কৌতুহলী হয়ে জানতে পারলাম, প্রোডাক্ট শুধুমাত্র অর্থ বিনিয়োগ। ভিন্নতা শুধু অর্থের পরিমাণে। এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে প্রদানকৃত অর্থ নাকি ছমাসে দ্বিগুণ হয়ে যায়!

ইউনিপে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য টেকনোলজিকে কাজে লাগালো। গ্রাহককে তারা একটা একাউন্ট দিত। সেই একাউন্টে গ্রাহক তার বিনিয়োগের সকল তথ্য পেতেন। পয়েন্ট জমা হলে তার প্রাপ্ত অর্থ উত্তোলন করতে পারতেন। দারুণ সব ব্যবস্থা। ইউনিপে মাটি খুঁড়ে নাকি সোনা তুলে। আর সেই সোনার কারবারের লভ্যাংশের টাকা দেয় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের, শহরের, বস্তির, পাহাড়ের, সমতলের, হাওরের সেই বিনিয়োগকারীদের।

আমার সেই নিকটজন অনেক আত্মীয়ের গহনা, বিধবার জমানো টাকা, মসজিদের ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে থাকা লোকটির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বিনিয়োগ করালেন। সবাই এই ফটকা জুয়ায় শরিক হলেন। সেই নিকটজন নিশ্চয় তার কমিশনের টাকা পেয়েছিলেন। তবে বিনিয়োগকারীদের কেউ তার অর্থ আর ফেরত পাননি।

আমি অনেকদিন পত্রিকা পড়িনা। আমার বাসায় টিভি নেই। পত্রিকা আর টিভি বর্জন করার প্রায় পাঁচ বছর হল। তাই পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবর দেখা থেকে বঞ্চিত হই। অনেক খবর এজন্য আমি পাইনা। তবে আমি ফেইসবুক ব্যবহার করি নিয়মিত। বেশকিছুদিন থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় ইভ্যালি নামের একটা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে বেশ মাতামাতি দেখি। এরা নাকি এমন কম মূল্যে নানান ব্রান্ডের জিনিসপাতি সরবরাহ করে এমনকি সত্তরহাজার টাকার জিনিস দশহাজার টাকায় দিয়ে দেয়!

ইভ্যালি বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে তার গ্রাহকদেরকে ডেলিভারি দেয়। আমার মাথায় ঢোকেনা যেখানে কোম্পানি নিজেই সাতগুণ বেশি দামে বিক্রি করে সেখানে অন্য এক রিটেইলার কিভাবে একই পণ্য সাতগুণ কমে বিক্রি করে? ইভ্যালি তাদের কোনো কোনো গ্রাহককে এরকম অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করেছে। আর সেই বিশ্বাসে গ্রাহকেরা উৎফুল্ল হয়ে তাইরে নাইরে করে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ইভ্যালিতে।

লোকজন এখন আর পণ্য পাচ্ছেন না। টাকাও পাচ্ছেন না। কোনো সদুত্তর পাচ্ছেন না। অফিসে গেলে দেখা পাচ্ছেন না। বেশি চাপাচাপি করলে হুমকি ধামকি পাচ্ছিলেন অবশ্য। গ্রাহকদেরকে প্রাণনাশের হুমকিও পাচ্ছেন। খবরে জানলাম, ইভ্যালির যে সম্পদ আছে তা দিয়ে কেবল ১৬ ভাগ দায় মেটানো সম্ভব। কোম্পানির এমডি বা চেয়ারম্যান নাকি জানেন না কিভাবে তারা তাদের বকেয়া পরিশোধ করবেন! তারা নাকি কোম্পানিটিকে দেউলিয়া ঘোষণার পাঁয়তারা করছিলেন।

আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে গ্রেফতার করেছে ইভ্যালির চেয়ারম্যান আর এমডিকে। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এরকম ফটকা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান উদ্যোক্তা নিজে হলে বউ হয় এমডি। আর নিজে এমডি হলে বউকে বানায় চেয়ারম্যান। রিজেন্ট বা ইভ্যালির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে দেখলাম। এ যেন, মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন! গতকাল থেকে এই দম্পতি কারাগারে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলেন। এদিকে গ্রাহকদে কেউ কেউ বিক্ষোভ করেছেন এদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। বাইরে থাকলে নাকি গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ হতেও পারে! যুবকের অভিজ্ঞতায় গ্রাহকদের এই প্রতিক্রিয়া। ইভ্যালির রাসেলের পক্ষে স্লোগান দেয়ায় গতকাল আদালত এলাকা থেকে নাকি এক যুবকেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

সীমাহীন লোভী হয়ে উঠছে সমাজ। ফটকা ব্যবসায়ীরা লোভী মানলাম। তাহলে গ্রাহকেরা কি ধোয়া তুলসীপাতা? দশটাকার জিনিস তিনটাকায় পাওয়া কি সীমাহীন লোভের বহিঃপ্রকাশ নয়? সাড়ে চারহাজার টাকা বিনিয়োগ করে আরও শত শত মানুষকে বিনিয়োগ করিয়ে তার লুটপাটের ভাগে শরিক হওয়াটা কি অপরাধ নয়?

লোভ করা পাপ। লোভ পরিহার করা খুবই জরুরি। এই রিপু মানুষকে গ্রাস করে ফেলে। হিতাহিতজ্ঞান নষ্ট করে দেয়। নূন্যতম নীতি আর সততা নিজের মধ্যে লালন করা উচিত। ফটকা ব্যবসার ঝুঁকি জেনে তাতে অংশ নিন। জুয়া খেলার নিয়মে ফটকায় যোগ দিন। আর না হলে এগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। অন্যকে দোষারোপ না করে নিজেকে প্রশ্ন করুন।

সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে আরও তৎপর হওয়া দরকার।

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ 

উন্নয়নকর্মী, লেখক, প্রাবন্ধিক। আরডিআরএস বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান হিসেবে কর্মরত।
samadsust22@gmail.com

user
user
Ad
Ad