`

গহীন হেঁতাল বনে!

  • Views: 2699
  • Share:
জুন ৬, ২০২৩ ২০:৩০ Asia/Dhaka

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল:: বাংলাদেশ রূপ-বৈচিত্রে ভরপুর নান্দনিক আভায় আচ্ছাদিত এক জনপদ।যেখানটায় নানা কিসিমের রুপ রস স্বাদ রসবোধের বিপুল সম্ভার দৃশ্যমান। এ দেশটার সর্বত্র পরিভ্রমণের ইচ্ছে থাকলেও সময় সুযোগ সাধ্যের ঘাটতির অজুহাতে এসবে ষোলকলা পূরণ সব সময় হয়ে উঠে না।কবি সাহিত্যিক ভ্রমণ পিপাসুদের প্রিয় আস্তানাই হলো এদেশ।যেখানটায় অবলীলায় ক্ষণ অতিবাহিত করে স্মৃতির পাঠাগার সমৃদ্ধ করা যায়। 

আর এসব আয়োজনে যদি আশির্বাদ স্বরুপ সামাজিক মানবিক স্বজনের হাত প্রসারিত থাকে তাহলে উপলব্ধি এবং উপভোগ শতগুণ বেড়ে যায়।বাংলাদেশের দক্ষিণে যাওয়ার শখ থাকলেও উপলক্ষ এবং সুযোগ তৈরি না হওয়ায় এসব অধরাই ছিল।সুযোগ পেয়েই লুফে নেই।যদিও এ যাত্রায় রাঙ্গামাটি যাওয়ার ব্যাপারে তাগাদা ছিল।এসবে রাজি হতে রসদ জুগিয়েছে সমাজের সফল গবেষক রেজাউল করিম ভাই এবং বিসিএসের চৌকষ কর্মকর্তা স্নেহাস্পদ মহসিন এবং সাস্টিয়ান শায়লা সাথীর আন্তরিক আহবান।রথ দেখা এবং কলা বেচা এ মন্ত্রকে পুঁজি করেই খুলনা অভিমুখে যাত্রার সিদ্ধান্ত। যাত্রার সিদ্ধান্ত যে রতি পরিমাণ ভ্রম হয়নি তা অবলোকনেই অনুমেয়।এ স্মৃতি হাতড়িয়ে অনেক দিন  সুখ অনূরণন এবং অনুভব করতে পারব।

 ২৫ শে মে প্রত্যুষে শুরু হয় আমাদের যাত্রা।দিন কয়েক আগ থেকেই  রেজা ভাই এবং মহসিনের নানা পয়গাম শরীর ও মননে আনন্দের ফলগুধারা প্রবাহিত হচ্ছিল।আমাদের গাড়ি আগাচ্ছিল এবং স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছে ধীরলয়ে নাগালের পানে আসতে লাগলো।মোংলাপোর্ট ভ্রমণ এবং এর ভিতরকার কর্মযজ্ঞ চাইলেই দেখা যায় না।পূর্বানুমতি  ব্যতিরেকে এসব ফিকে হয়ে যায়।মহসিন এবং রেজা ভাই এসব থেকে কি আমাদের বঞ্চিত করতে পারেন? যাত্রাপথে প্রায়শই কেন জানি নেট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটা সাম্প্রতিক সময়ে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।দুজন বারবার নানা তত্ত্ব উপাত্ত পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন- চাইলেই এসব সহজে পাঠানো কি আমার পক্ষে সম্ভব?এসবে আমার হাত বরাবরই কাঁচা।এ যাত্রায় সকল কাজের সাথী জীবনসঙ্গীর সহায়তায় স্মার্ট কার্ডের তথ্য মহসিনের গ্রীবে পাঠাতে সক্ষম হই।পেয়ে যাই মোংলাপোর্টে প্রবেশের অনুমোদন।পথে এমন সংবাদে সামনের সময় টুকুন যে ভালো হবে তা আঁচ করতে পারি।

মহসিনের সাথে জীবনে একবার সিলেটে দেখা হয়েছিল। সে যাত্রায় তাকে তেমন খাতির আদর সমাদর করার ফুসরত পাইনি।জাগতিক ব্যস্ততায় ততটা হিতৈষী হতে পারেনি।যে কিনা আমার জীবন সাথীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী।অল্পতেই তার সাথে  সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি।অবশ্য কেনইবা ঝুঁকে পড়ব না যার নামের সমার্থ হল সৎকর্মশীল।পরিচয় এবং কর্মে এত মিল ধরণীতে বেশ বিরল।আর শ্রদ্ধেয় রেজা ভাই যাকে দক্ষিণ বাংলার সুশীল সমাজে গবেষক এবং মোটিভেশনাল বক্তা হিসেবে এক নামেই চিনে। প্রথমবার বরেন্দ্র অঞ্চলে দেখলেও সম্পর্কের পূর্ণতা পায় ভারতের গোয়ায় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে দেখা মেলার মাধ্যমে। সে সময়ের দিনগুলো বেশ উপভোগ্য ছিল।এ মানুষটার সাথে সিলেটে দেখা হলেও সেভাবে সময় দেয়া হয়নি। আর এ মানুষগুলি যা করল তা ইতিহাস।এমন ভালোবাসায় আপ্লুত।এসবে ফারহানা ইসলাম ও কৃতজ্ঞতা পেতে পারে কারণ কর্মক্ষেত্রের এসব গুণীজনের সান্নিধ্যে আসার মওকা তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল।

দু'টো দিন যেন কল্পনা এবং ভাবতে ভাবতেই শেষ হয়ে যায়। সুন্দর সময়ের স্থায়িত্ব কেন এত অল্প হয়? এ সময়ে দিন কেন ছোট হয়ে আসে? দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতিটা কি হতো? কয়েক বছরে দক্ষিণবঙ্গে উন্নয়নের পারদ এত বেশি উর্ধ্বমুখী হয়েছে যা কিনা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ন্যায়  বদলে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। এ সেতু দেখার ইচ্ছেও মনের গহীনে উঁকি  দিচ্ছিল। এসব পূরণে বেশ আপ্লুত। যার নির্মাণ ২০১৪ তে শুরু হয়ে ২৫ শে জুন ২০২২ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সফল সমাপ্তি হয়েছে।এ  পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয়তা পুরো বিশ্ব অবাক বিস্ময় অবলোকন করেছে। এর সুফল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঊনিশটি জেলার নাগরিকরা বেশ উপভোগ করছে।

খুলনায় রাত আটটা অবধি পৌঁছে যাই।সঙ্গী হিসেবে ছিল  জাদরেল অধ্যাপক জলিল। যে কিনা ঠান্ডা মাথার মানুষ এবং কখনোই কারো জন্য ক্ষতিকর নয় তার সান্নিধ্য এ ভ্রমনে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। কোন কাজেই সে অপারগতা প্রকাশ করেনি। পরীক্ষা দপ্তরের মুহিত সাহেব এবং রাকেশদা পুলিশের মুশাহিদ এবং মুজাম্মিলের উপস্থিতি পুরো ভ্রমণে একবারের জন্যও বিরক্তির পরিবেশ তৈরি হয়নি। পরদিন সকালে মহসিন এবং রেজা ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে পুরো টিমকে নিয়েই বের হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাকিরা সময় একটুকুন ও নষ্ট না করার তাড়নায় বাগেরহাটের খান জাহান আলী এবং করমজল চষে বেড়ায়। এবং বুদ্ধি করে মোবাইল ফোন বন্ধ এবং নেটওয়ার্ক না থাকার সুযোগে তারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে উনারা ও বেশ মজা করেছে এবং উপভোগ করেছে যা আমাকে সুখী ও আনন্দ দিয়েছে।

 মোংলাপোর্টে প্রবেশের মাধ্যমে সুন্দরবনের হেঁতাল রাজ্যে প্রবেশের হাতছানি। বাগেরহাটের রামপালের পশু ও মোংলা  নদীর মোহনায় এ বন্দরের যাত্রা ১৯৫০ সালের দিকে। যেখানটার সাথে বিশ্বের প্রায় সকল বন্দরের সংযোগ রয়েছে।পোর্ট থেকে বের হয়ে জালিবুটে করমজলের দিকে যাত্রা।সুন্দর নৌকা এবং ছাদের আয়োজন মহসিন এবং রেজা ভাইয়ের নিঃস্বার্থ আতিথেয়তা এবং দূর থেকে নিষিদ্ধ পল্লীর কীর্তি মহসিনের রসিকতা পশু নদীর নীরব পরিবেশ এবং চারিদিকে লাইটার জাহাজ সারাক্ষণ ভালোলাগার মূর্ছনা তৈরি করছিল।

সুন্দরবন সম্পর্কে তেমন জানাশোনা ছিল না।ম্যানগ্রোভ বন যেখানটায় বাঘ হরিণের খেলা হয়। নানাপদের গাছ-গাছালি পশু পাখির কলরবে মুখরিত এবং যার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোন এবং দৈব বিপাক থেকে এ জনপদকে নিয়ত সজীব রাখা।এ বনের নামকরনে নানা কেচ্ছা কাহিনী প্রচলিত আছে। অধিকাংশের ধারণা সুন্দরী নামক ম্যানগ্রোভের আধিপত্যের প্রভাবেই এমন নামকরণ।জনশ্রুতি আছে  ইংরেজ আসার পূর্বে ফরাসি উপনিবেশিক জামানায় এ স্থানের নামকরণ স্যান্ডারবন ছিল যা কিনা বিভিন্ন দলিল দস্তাভেজে পাওয়া যায়।সময়ের ধারাবাহিকতায় সাঁদরবন এবং রূপান্তরিত হয়ে সুন্দরবন এসে ঠেকেছে।করমজল বাগেরহাটে যেখানটায় কুমির প্রজনন কেন্দ্রের অবস্থান।এ পথে কাঠের ট্রেইল টাওয়ার বানর হরিণের সাথে মোলাকাত এবং জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ে।বনের অন্যতম আকর্ষণ ট্রেইল ছাড়া হাঁটা বারণ।কারণ ম্যানগ্রোভের প্রভাব। এমন পরিবেশে ঘুরতে বেশ ভালই লেগেছে যা কিনা পরবর্তী টুরের স্বপ্ন জাগিয়েছে।

বনের অন্যতম ভালো লাগার স্থান হল হেঁতালবনের সাথে মিতালী। রেজা ভাইয়ের  গম্ভীর বর্ণনায় এসবে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি।হেঁতাল গাছ দেখতে অনেকটা খেজুর গাছের মতো।এ গাছের পাতাও কাঁটাযুক্ত। অনেক ঝোপ থাকে।খাল-নালা এবং নদীর পারে এ গাছের দেখা মিলে।করমজল পয়েন্টে এ গাছের আধিক্য বেশি।নোনাজল কাদামাটিতে এসব দ্রুত বেড়ে ওঠে। এবং যেখানটায় কি না বাঘ মামা হরিণ শিকারের নেশায় উৎপেতে অপেক্ষায়  থাকে।অজানা আতংকে গাঁ শিউরে উঠে। যদিও বর্তমানে বাঘের সংখ্যা এবং জনসম্মুখে এদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।কেননা সর্বশেষ বন বিভাগের শুমারী অনুযায়ী মাত্র শ'খানেক বাঘের চলাফেরা এবনে রয়েছে।

চুইঝালের স্বাদ যেন বাড়তি আনন্দের সুযোগ করে দিয়েছে।নামের সাথে পরিচয় থাকলেও কখনো স্বাদ গ্রহণের সুযোগ হয়নি।সুহৃদদ্বয় বিখ্যাত আব্বাস হোটেলে রসনা  বিলাসের বিনোদন দিয়েছেন তা অনেকদিন মনে থাকবে। চুইঝাল মশলা জাতীয় ফসল।যার কান্ড শিকড় শাখা প্রশাখা সবই মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা কিনা গ্যাস্ট্রিক কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খাবারে বাড়তি রুচিবোধ সৃষ্টি করে।পাকস্থলী প্রদাহে ও এ মশলা বেশ কার্যকরী।অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে  কাজ করে বিধায় চুইঝাল ক্যান্সার প্রতিরুধে ও ভুমিকা রাখছে। যার স্বাদের ভক্ত হয়ে গেলাম।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে চৌদ্দ  কিলোমিটার দূরে। খুলনা যশোর মহাসড়ক দিয়ে যেতে হয়। সেখানকার রোকেয়া হলের প্রভোস্ট  শায়লা সাথী যে কিনা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের জুনিয়র। তাকে না দেখে এবং নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে কি বাড়ি ফেরা যায়?সাস্টিয়ান আবেগ বন্ধন এতটা ই শক্তিশালী  যা রীতিমতো অন্যদের ঈর্ষার কারণ ও বটে।এ পথে যেতে যেতে মৌসুমী ভৌমিকের গানের সেই বিখ্যাত যশোর রোডের স্মৃতি ও অনুভব করার সুযোগ হলো।কুয়েটের ছিমছাম  পরিপাটি পরিবেশ সফি স্যারের  আদরের  মেয়ের বর্তমান অবস্থান এবং তার আন্তরিক আতিথিয়তা ক্ষণিকের তরে হলেও ছাত্র জীবনে ফিরে যেতে পেরেছিলাম।ধন্যবাদ সাথী এমন সময় ও সুযোগটুকু করে দেয়ার জন্য।এসব মনে থাকবে অনেকদিন।

রাঙ্গামাটি প্রত্যাখ্যান করে খুলনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে শতভাগ সঠিক ছিল তা প্রতি পলকে অনুভব করেছি। বিশেষত ব্যস্ততা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণের প্রভাবে যেখানটায় মানুষ সর্বদা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এমন ক্ষণেও আপনাদের মহানুভবতায় আমরা ঋণী।যদিও সমাজ চিন্তনে আপনার অনেক তাগাদা সত্ত্বেও সাড়া দিতে পারিনি এ দায় টুকু ক্ষমা করবেন। পৃথিবীতে এসব মানুষ আছে বলেই নানা অসঙ্গতি অস্থিরতা অশুভ ক্রিয়ার মাঝে ও জীবন পরিবেশ এত সুন্দর। এ ভ্রমণের সেরা প্রাপ্তি আপনাদের সান্নিধ্য।যা চাইলেই কি ভুলে থাকা যাবে? এসব মানুষের হাত ধরেই ধরণী বিকশিত এবং প্রস্ফুটিত হবে কালান্তর ।আশা এবং বিশ্বাস হেঁতাল বনে আবারো বাঘ মামার আনাগোনা বাড়বে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় এ-বন ত্রাতার ভুমিকায় থাকবে।

লেখকঃ ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল
অধ্যাপক , সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

user
user
Ad
Ad