`

নাড়ীর টান

  • Views: 4156
  • Share:
জানুয়ারী ২২, ২০২৩ ১১:৫৪ Asia/Dhaka

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল:: ছাতিয়াইন এম ই স্কুল থেকে রুপান্তরিত হয়ে কালের অমোঘ নিয়মে আজ এ নিকেতন স্কুলের গন্ডি  বিস্তৃত করে কলেজ অবধি পৌঁছেছে। যদি ও বিধাতার লিখনে এ আংগিনার সারথি হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ এবং শানিত করার মওকা পাইনি। বংশ পরস্পরায় পরিবারের  অনেকেই এ অঙ্গনে কলি থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে জগতের নানা ক্ষেত্রে আজ আলোর রোশনাই বিলাচ্ছে।

 এ দিকটায় কিছুটা মনের আক্ষেপ তো আছে ই। শতবর্ষ উৎসব আয়োজক কমিটির কাছে অনেকটাই কৃতজ্ঞ যেখানটায় পায়ের চিহ্নের দাগ বসাতে পারেনি-  সেই উৎসব কে ঘিরে ই কিনা বাতচিতের কিঞ্চিৎ আস্ফালন।শুরুতে লিখার অনীহা জানালে ও তাদের পীড়াপীড়িতে দু-কলম কথন।যা যতটা না এ নিকেতন কে ঘিরে বরং এর অনেক টুকুই এ গ্রামের আলো-বাতাসের দায়ের স্বীকৃতি এবং আকুতি ই মানস পটে ভেসে আসছে।

গ্রামের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা যেখানটায় আমার প্রিয় মায়ের বসতি নাগরিক  ব্যস্ততার মাঝে ও সবসময় যেখানে যেতে স্বাচ্ছন্দ এবং পুলক অনুভব করি, মানুষের সাথে মিশতে কাঁদতে গল্প আড্ডায় এখনো দিনের পর দিন পার করার হিম্মত ও রসদ পাই। প্রিয় গ্রামের প্রিয় স্কুলের আজ রং লেগেছে।ভাবতেই  ভালো লাগছে। ত্রিপুরা ক্যালকাটা ঢাকা চট্টগ্রাম কানাডা আমেরিকায় এ প্রতিষ্ঠানের অগ্রজেরা রাজনীতি চিকিৎসা ব্যবসা সাংবাদিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে  স্মরণীয় অবদান রাখছে।

মেধাবী এবং ভালো ছাত্রের অনুজ হিসেবে এ স্কুলের  মাননীয় শিক্ষকগণের স্নেহ  ভালোবাসা আমাদেরকে সামনে চলার অনুষঙ্গ হিসেবে জ্বালানি সরবরাহ করেছে।আমার বাবা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নির্লোভ এবং শিক্ষা দরদী হওয়ার কারণে  এলাকার  অনেকেকেই  উনার স্নেহ এবং পরামর্শের চাদরে আচ্ছাদিত হতেন।যার কারণে তৎকালীন সময়ের মেধাবী মুখ জাদরেল আমলা প্রদীপ দা ফরহাদ চৌধুরী, বুয়েটের ছাত্র  শিবলী  চাচা গাড়াউকের নুরুজ্জামান ভাই ধরমন্ডলের কাউসার ভাই শিমুলঘরের ইকবাল চাচা  জাকির মামা এডভোকেট তাহের ভাই বিসিএস কর্মকর্তা স্নেহাশীষ ফখরুল সহ সবার সাথেই আত্নিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল।যা এখনো বর্তমান আছে। ওনারা প্রায় সবাই ঈদ পার্বণে  বাবার সাথে দেখা করার মানসে আমাদের বাড়িতে আসতেন যা আমাদের কে বেশ প্রেষিত এবং আনন্দিত করতো।আমাদের বাড়িতে হাই স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষকেরই নিয়মিত যাতায়াত ছিল।এ স্কুলের  ছাত্র না হয়ে ও আজহার স্যার মাওলানা মুখলিছুর রহমান মিলন স্যার রেবতী স্যার বিএসসি ফজলু স্যার মাওলানা শফিক ভাই সহ অনেকের আশির্বাদ আমাকে সামনে আগানোর প্রেরণা যুগিয়েছে। এমন দিনে সবাইকে খুব বেশি মনে পড়ছে। 

  মা মাটি মাতৃভাষার প্রতি স্বজাত্যবোধ টান এবং মমতা সবারই থাকে।যে মানুষের এসব ক্ষেত্রে সামাজিকতার ঘাটতি রয়েছে সে হয় পশু না হয় দেবতা। সমাজে বসবাস করতে হলে পারস্পরিক যোগসাজশ ঐক্যতান আন্তঃসম্পর্ক এসবের চর্চার মাঝেই মানবের পরিপূর্ণতার আবহ তৈরি হয়।যদি প্রিয় নবীর স্বদেশ প্রেমের বিবরণ অনুরণন করি যেথায় দেখা যায় হিজরতের প্রাক্কালে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে নবীর মন বড়ই ব্যতীত হয়েছিল।তাইতে বলতে শোনা যায় "ভূখণ্ড হিসেবে  তুমি কতইনা উত্তম, তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।" মায়ের ভিটার প্রতি টান এতই প্রবল ছিল যে প্রায়শই মক্কায় প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতেন।যার কারণেই মহান প্রভু কোরআনে প্রতিশ্রুত করেন এভাবে "যিনি তোমার জন্য কোরআনকে বিধান বানিয়েছেন। তিনি তোমাকে অবশ্যই সেই জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।" (সুরা কাসাস,আয়াতঃ ৮৫)।বিপ্লব সংগ্রাম অর্থনৈতিক প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা নানা কারণে মানুষের প্রবাস জীবনের সুযোগ আসলে ও নাড়ীর বাঁধন এবং শিকড়ের পানে কিছুটা সময় দেয়ার আগ্রহ এবং লোভ সকলেই পোষণ করে।

এ নিকেতনের প্রতি শৈশব থেকেই ভালবাসা এবং আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কারণ এইখানটায় আমার অগ্রজেরা মেধা ও যোগ্যতা স্বাক্ষর রেখে  আজ স্বনামে  প্রতিষ্ঠিত। ভাই প্রতিবেশী এবং স্বজনের বাগানে খানিকটা সময় দেয়ার  আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষা থাকলে ও যাদের পরশে এবং ছোঁয়ায় এ বাগান  সতেজ এবং সামনে আগুয়ান তাদের অনুমতি বিনে প্রজন্মের পথচলার  বাহন হতে পারছি না। কিসের যেন অভাব? ভাবতে ও অবাক লাগে শিক্ষিত মেলেএরকম কি হওয়ার কথা ছিল? যা ব্যথিত করে।

এ এলাকার সন্তান হিসেবে এর ভালো মন্দের অংশীদার হওয়ার আগ্রহ যেমন অমূলক নয় এবং পাশাপাশি দায় ও আছে।সামান্য সুযোগেই হাত প্রসারিত করার চেষ্টা করেছি। সিলেট শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন কলেজ পরিদর্শক মরহুম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার মহোদয়ের বদান্যতায় এবং কর্তৃপক্ষের আগ্রহে বর্তমান প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে কলেজ পরিদর্শনের ইতিবাচক অনুমোদনে ভুমিকা রাখতে পেরে  কিছুটা সুখ অনুভব করি। এ সুযোগে নোয়াপাড়া এবং জগদীশপুর স্কুলের কলেজ পরিদর্শনের অনুমোদনে ও ভূমিকা রাখার সুযোগ পাই।

সবাই শিকড়ের টানে ফিরতে চায়। অগ্রজ ডাক্তার আজম যিনি বিদেশে বিভুইয়ে থাকলে ও এলাকার শিক্ষা প্রসারে নীরবে নিভৃতে কাজ করার অন্তঃপ্রাণ হিসেবে অত্র প্রতিষ্ঠানের অসচ্ছল ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে আকবর মর্তূজ ফাউন্ডেশনের ব্যানারে ২০০৯ সাল থেকে অদ্যবধি ধারাবাহিকভাবে আর্থিক বৃত্তি দিয়ে আসছেন।ফাউন্ডেশনের সভাপতি হিসেবে এ দিকটায় ও খানিকটা অংশগ্রহণের আনন্দে বিমোহিত হই। যদিও সাধ এবং সাধ্যের  মাঝে বেশ ফারাক আছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে কোন কাজে নিজেকে যে বা যারা যেভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে,  এলাকার প্রতি দরদ মায়া এবং দায়ের বাধ্যবাধকতায় কথোপকথনে কখনও পিছপা হইনি।

শতবর্ষী একটা প্রতিষ্ঠান যেভাবে আলো এবং আভা ছড়ানোর কথা ছিল, কোথায় যেন শূন্যতা? সুস্থ  স্বাভাবিক কলি থেকে আমরা যেভাবে সুঘ্রাণ পাওয়ার আশা করেছিলাম, এ নিকেতন পারছে কি তার তকমার মর্যাদা রাখতে? হাতেগোনা কয়েকজন ভালো করলে ও মোটা দাগে স্কুলের কীর্তি আজ প্রশ্নবিদ্ধ? আশির দশকে যে অনৈতিক চর্চার প্রায় অনুপস্থিত ছিল, সেখানটাই কিনা পন্ডিতেরা বাড়ির খাস কামরাকে বিকল্প জ্ঞান বিতরণের আস্তানায় পরিণত করেছেন। ভাবতেই ঘেন্না লাগে, এখানটায় যদি পচন ধরে আমরা যাব কোথায়? 

এ পবিত্র অঙ্গনের আলোকিত  ফুল সমৃদ্ধ করুক দেশ সমাজ মা এবং মাটিকে।এর ফল এলাকাবাসী হিসেবে আমাকে শাণিত, প্রেষিত এবং হিন্দোলিত করবে। কারণ এ প্রতিষ্ঠান আমার গর্ব এবং অহংকারের ধন।এ কে কোন ভাবেই সার কীটনাশকের অভাবে রুগ্ন হতে দেয়া যাবে না। এ কে বাচিঁয়ে রাখতে হবে প্রজন্মের স্বার্থে। এলাকার প্রতি টান এবং মমত্ববোধই পারে ইনকিভেটর থেকে এ কে সামনে নিয়ে আসতে। কবি নজরুলের জবানিতে যা ফুটে উঠেছে এভাবে "স্বদেশের উপকারের নাই যার মন,কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।" অগ্রজ অনুজ যারা এই বাগিচার আলো বাতাসে বড় হয়েছেন তাদের দায় অনেক।যদি নিজেকে মানুষ হিসেবে মেলে ধরতে চান তাহলে -আঙ্গিনার সম্প্রসারণ এবং গৌরব বাড়াতে  নিজেকে সম্পৃক্ত করুন।  এবং আগামীর প্রজন্মকে যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রেষণা  দিন। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়। 

(শতবর্ষ উৎসব, শিকড়ের টানে স্মরণিকায় প্রকাশিত)

লেখকঃ ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল
অধ্যাপক , সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 
ইমেইল: alioakkas@gmail.com

user
user
Ad
Ad