`

সিলেটের চা শ্রমিকদের জীবনঃ দুইশত বছরের শোষণের খন্ডিত চিত্র

দুইশত বছরের বন্ডেড স্ল্যাভারির একটা নিষ্ঠুর উদাহরণ আমাদের চাবাগানগুলো। সাম্প্রতিক সময়ের চা শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখার জন্য অনুরোধ করেছেন আমার অনেক শুভাকাক্সক্ষী। ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আমার বই "দুন্দুবুড়ির" একটা চ্যাপ্টার তুলে ধরলাম পাঠকদের জন্য।
  • Views: 4433
  • Share:
আগষ্ট ১৯, ২০২২ ১৯:৫২ Asia/Dhaka

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ::  আমাদের সিলেটের চা-বাগানগুলোর ইতিহাস দীর্ঘদিনের পুরনো। সিলেট অঞ্চলের এই চা-বাগানগুলি স্থাপিত হয় প্রায় দুইশত বছর আগে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান দিয়ে চা চাষের সূচনা হয় এদেশে। অবশ্য তারও আগে ১৮৪০ সালে চীন থেকে কিছু চায়ের চারা এনে বোটানিক্যাল গার্ডেন আর চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়েছিল। সেটা বেশিদূর এগোয়নি বা সফল হয়নি তখন। পরবর্তী সময়ে সিলেটের মালনীছড়ায় চায়ের সফল চাষ শুরু হয়।

চা-বাগানের কর্তাব্যক্তিরা প্রথমদিকে ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। তাই চা-বাগানগুলোতে একধরণের পশ্চিমা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। দেশীয় কর্মচারী বাবুরাও তাদের পশ্চিমা প্রভুদের অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। তারাও চালচলনে, আচার-ব্যবহারে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে চর্চা করতে চাইতেন। তাই ধীরে ধীরে একটা মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল বাগানগুলিতে। পরবর্তীকালে অবশ্য চা-বাগানগুলোর শীর্ষ পদগুলোতে দেশীয়দের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। পরিবর্তন এলেও বেশকিছু চর্চা, যা ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিখেছিল তা জারি রাখে এদেশীয় কর্মচারীরা। নিজেদের লোককে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে তারা সফল প্রয়োগ করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে শেখা কলাকৌশলগুলো। ব্রিটিশদের শেখানো কিছু ভালো চর্চাও তারা চালু রেখেছিল যেমন খেলাধুলা, শরীরচর্চা ইত্যাদি। অবশ্য কেউ কেউ মদ্যপানও জারি রেখেছিলেন ব্রিটিশদের দেখানো পথ অনুসরণ করে।

আসাম, বিহার, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ভাল কাজ আর উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে নিম্নবর্ণের ওঁরাও, নুনিয়া, মুন্ডা, বোনাজ সম্প্রদায়ের লোকজনকে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে চা-বাগানগুলোতে। দুঃখজনক হলো যে, দীর্ঘ আর ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় আসার পথেই তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। ব্রিটিশরা প্রথমে তাদের চার বছরের চুক্তিতে নিয়ে আসে। বাকিটা তো ইতিহাস; যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেড়শত বছরেরও বেশি সময় পার হওয়ার পরেও তাদের অলিখিত চুক্তি আর দেশহীন উদ্বাস্তু জীবন চলছে। আধুনিক দাসত্বের একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই চা-শ্রমিকদের জীবন। এটা বন্ডেড সেøভারির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চার বছরের চুক্তিতে শ্রম বিক্রি করতে আসা এই মানুষেরা এখন এই দেশকেই নিজের দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকার হয়েছে বাংলাদেশে। নাগরিক হিসেবে সকল অধিকারও ভোগ করার কথা তাদের।

স্বাধীনতার পরে এই চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হন। কিন্তু তাদের দিনপ্রতি অনেক কম উপার্জন নিয়ে এখনও সেই শ্রমিক লাইনেই তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে চা-শ্রমিকদের অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের বীরত্বগাথা বর্ণিত আছে ইতিহাসে। কিন্তু মুক্তি মিলেছে কিনা সেটা নিয়ে অবশ্যই বিতর্ক আছে। বছরের পর বছর তাদেরকে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যন্নোয়নের কথা মূলধারার রাজনীতিবিদদের কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর বাড়ি ছিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে। ঐ এলাকায় বেশ কয়েকটি চা-বাগান রয়েছে। এই এলাকা থেকে জাতীয় নির্বাচনে একজন নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসতেন বছরের পর বছর। চা-শ্রমিকরা তাকে ভোট দিত মার্কা দেখে। আমার বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঐ রাজনীতিবিদ যিনি তাদের ভোটে নির্বাচিত হন তার জনপ্রিয়তা কেমন চা-শ্রমিকদের মধ্যে। আমার বন্ধু বলেছিল, তাার নাম বললে চা-বাগানের লোকজন তেড়ে আসবে মারার জন্য। তারা প্রচÐ ক্ষুব্ধ ঐ ব্যক্তির ওপর অথচ তাদের ভোটেই তিনি নির্বাচিত হয়ে আসছেন বছরের পর বছর। সহজ সরল এই মানুষগুলোর কথা কেউ ভাবে না। সবাই তাদের ব্যবহার করেই আসছে, যেটা শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা গেছে, পাকিস্তানিরা গেছে, স্বপ্নের বাংলাদেশ হয়েছে কিন্তু তারা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

চা-বাগানে গেলে মনোমুগ্ধকর বাহারি ফুলবাগানবেষ্টিত বিলাসবহুল বাংলোবাড়িগুলো দেখতে পাবেন। বাবুদের সুন্দর সুন্দর সাজানো কোয়ার্টারও দেখতে পাবেন। বাংলোগুলোতে আরাম, আয়েশ আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো কমতি দেখতে পাবেন না। আর বাগানগুলো যাদের শ্রমে টিকে আছে তাদের জীবন পর্যবেক্ষণ করলে বৈষম্য খুব সহজেই অনুমান করতে পারবেন। দুর্দশা আর দৈন্য খুব সহজেই চোখে পড়বে। চা-শ্রমিকদের হতদরিদ্র অবস্থা চোখ এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না।

বাগানের পক্ষ থেকে এক কক্ষের একটা ঘর আর রান্নাঘর পায় একজন শ্রমিক। বাগান কর্তৃপক্ষের সেগুলো মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিজেদেরকেই তা করতে হয়। জমির উপর শ্রমিকদের কোনো মালিকানা নেই। বাগান কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় যে কাউকে উচ্ছেদ করতে পারে অথবা নতুন জায়গায় স্থানান্তর করতে পারে। এটা এক উদ্ভাস্তু জীবন। আর এই জীবন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে যখন তাদের পূর্বপুরুষেরা উন্নত জীবনের আশায় আর অধিক রোজগারের আশায় তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে এখানে এসেছিল ব্রিটিশদের কথা বিশ্বাস করে। সেই উদ্ভাস্তু জীবন আজও চলছে।

চা-বাগানের টিলাবাবুরা হাফপ্যন্ট আর কেডস পরে দিনের বেলায় কাজ করতেন। চা-শ্রমিকদের বেশিরভাগ লোকজনও হাফপ্যন্ট পরত। শীতকালের বিকেলবেলা স্পোর্টস ড্রেস পরে ব্যাডমিন্টন খেলতেন অনেকেই। ক্লাবে গিয়ে আড্ডা মারতেন কেউ কেউ। ইনডোর খেলার সরঞ্জামও ছিল চা-বাগানের ক্লাবে। সেগুলোও উপভোগ করতেন কেউ কেউ। আর এই সকল সুবিধা শুধুমাত্র হাতে গোনা কর্মচারীদেরে জন্য বরাদ্দ, যারা চা-বাগানে ‘বাব’ু নামে পরিচিত। চা শ্রমিকেরা সেগুলো পাহারা দেয়, রক্ষণাবেক্ষণ করে কিন্তু এগুলোতে তাদের প্রবেশাধিকার নেই।

বাগানে হরেকরকম বাবু আছেন, তার মধ্যে একজনের পদবী পাট্টাবাবু। এই পাট্টাবাবু হলেন মদের জিম্মাদার। মদের বিনিময় আর বিতরণের দায়িত্ব এই পাট্টাবাবুর। সাপ্তাহিক তলবের দিনে পাট্টাবাবুর কর্মচাঞ্চল্য সবচেয়ে বেশি। মজুরি পাওয়ার পরেই বেশিরভাগ শ্রমিক তার শরণাপন্ন হতেন। বাগান কর্তৃপক্ষ পুরো সপ্তাহের কাজের মজুরি দিয়ে মদ বিক্রি করে তার একটা বড় অংশ আবার নিজেদের পকেটে নিয়ে আসত। বাগানের পুরো ব্যবস্থায় আষ্টে-পৃষ্টে লেগে আছে শোষণ আর বঞ্চনা। অবশ্য বাগানের পাট্টাবাবুকে বেশ ধার্মিক মনে হতো আমার। আর ধর্মে কিন্তু মদ্যপান নিষিদ্ধ। ওটা ছিল তার চাকরি।

আমাদের হাইস্কুলে একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আব্দুল কাদির। একসময় চা-বাগানে চাকরি করতেন তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে শুনেছিলাম। অবশ্য আমাদের সময়ে সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো বাড়তি কদর ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, পাকিস্তানের দালাল আর সামরিক স্বৈরাচারীরা তখন মিলেমিশে একাকার। উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সাথে আঁতাত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তখন। আমাদের প্রজন্ম, “জাতি যখন কোনো নির্দেশনার অভাবে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য, তখন জাতির ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এলেন এক মেজর। বিদ্যালয়ে, পাঠ্যবইয়ে, রেডিও, টেলিভিশনে এটাই আমরা শুনতাম। যাহোক, কাদির স্যার বলতেন, এই চা-বাগানে মদ বিক্রির ব্যবস্থা রাখার পেছনে একটা কূটকৌশল কাজ করছে বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে। স্যার বলতেন, এটা ব্রিটিশদের শোষণকে পাকাপোক্ত করার একটা নীল নকশার অংশ।

তিনি বলতেন, তলবের দিনে মদের দোকান খুলে দেওয়ার কারণ হলো, যাতে শ্রমিকরা তাদের পুরো সপ্তাহের মজুরির টাকা পাওয়ার পরে মদ পান করে সেই টাকা উড়িয়ে দিতে পারে। আরেকটা উদ্দেশ্য, শ্রমিকেরা যেন কোনোক্রমেই সঞ্চয় করতে না পারে তাঁর সব ধরণের বন্দোবস্ত রাখা। একসময় তো চা-বাগানে মজুরির টাকা নগদে দেয়া হতো না। পুরো সপ্তাহের অর্জিত মজুরি দেওয়া হতো অধুনা ক্যাশ ভাউচারের মতন করে। বিভিন্ন মানের তামার কয়েন ছিল। মজুরির উপার্জনের উপর ভিত্তি করে কয়েনের ধরণ নির্ধারণ করে দেয়া হতো। আর সেই কয়েন দিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত দোকানে কেনাকাটা করা যেত। আর এই পদ্ধতিতে সঞ্চয়ের প্রশ্নই আসত না। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের ইচ্ছা এই বাগান সম্রাজ্যে বাতুলতা। আমার কাছে আরেকটা কারণ ছিল বলে মনে হয়, আর সেটা হলো শ্রমিকদেরকে মদের নেশায় বুঁদ করে রাখা। এর ফলে তারা তাদের ওপর চলতে থাকা শোষণের স্টিমরোলারের প্রতিবাদ করতে সংগঠিত হতে পারত না। প্রতিবাদের কথা ভুলে যেত। ভাবালুতায় জীবন কাটিয়ে দিত তারা। এটা এখনো চলছে চা-বাগানগুলোতে।

কাদির স্যারের যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে হয় আমার কাছে। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই অত্যাচারী আর শোষণমূলক ব্যবসা টিকে আছে এদেশে ভালোভাবেই। স্বীকার করতে হবে যে, চা মালিকদের এই শোষণের কৌশল বেশ কার্যকর আর টেকসই। আর এটা বেশ প্রমাণিতও বটে।

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ::
লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজ উন্নয়নকর্মী। বর্তমানে দেশের শীর্ষ উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের হেড অব প্রোগ্রামস হিসেবে কর্মরত।

user
user
Ad
Ad