`

অভিভাবকতূল্য গুণি শিক্ষক শ্রদ্ধেয় সিরাজুর রহমান আজ রোগাক্রান্ত

  • Views: 707
  • Share:
অক্টোবার ১২, ২০২১ ২৩:১১ Asia/Dhaka

ফয়সল আহমদ রুহেল, ইউকে :: একজন প্রকৃত শিক্ষকই ধারাবাহিকভাবে একজন ছাত্রকে সহজ থেকে কঠিনের দিকে, জানা থেকে অজানার দিকে, জ্ঞানের বিন্দু থেকে নিয়ে যান জ্ঞানসমুদ্রের দিকে। শিক্ষকতা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষক সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। সেই শিক্ষকরা শেষ সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অবহেলিত হয়, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। তারই একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুর রহমান। সহজ সরল এই মানুষটি এখন হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষ বয়সে নিজের জমি বিক্রি করেছেন। তারপরও চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে পারছেন না॥

এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুর রহমানের জন্ম ১৯৬০ সালের ১৫ জুন। তিনি সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের রনীফৌদ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজি হামিদ বক্স, মাতা গোলাপজান বিবি। ৯ ভাই ও ৬ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ১২তম। 

শিক্ষাজীবন::
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি পাকড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৭৭ সালে এসএসসি পাশ করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য মদন মোহন কলেজে ব্যবসা শাখায় ভর্তি হোন। মদন মোহন কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮১ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করার পর একই কলেজে বি.কম এ ভর্তি হোন। বি.কম এ ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠেন। তখন বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাকশাল এর সক্রিয় নেতা হয়ে উঠেন এবং কয়েক হাজার নেতাকর্মী তৈরি করেন। বি.কম ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার আগের দিন শিবিরের কর্মীরা তার ডান হাতের একটি আঙ্গুল কেটে ফেলে। তারপরও তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বাম হাত দিয়ে লিখেন এবং ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হোন। এরপর তিনি সিলেটের অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখায় চাকুরি পান। কিন্তু রাজনীতিতে সময় দেয়ার কারনে তিনি ১ মাস পর চাকুরী ছেড়ে দেন। 

শিক্ষকতা ::
সিলেটের গোলাপগঞ্জের সিরামিশ উচ্চ  বিদ্যালয়ে ৭/৮ বৎসর শিক্ষকতা করেন সিরাজুর রহমান ।সিরামিশ থাকাকালীন ডায়বেটিস ও হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। এরপর থেকে তিনি রাজনীতিতে থেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেন। পরবর্তীতে বাড়ির পাশে সারীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৯৪ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালের ১৫ জুন ৩৪ বৎসরের শিক্ষকতা জীবন শেষে অবসর গ্রহণ করেন।  তিনি ছাত্র অবস্থায় একবার রাজনৈতিক কারনে জেলে যান। 

তাদের বাড়িতে একটা আলাদা বসার ঘর ছিল। যেখানে প্রতিদিন ১০০/২০০ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আড্ডা হতো, গান হতো, খাওয়া হতো। যেকোন দিন হঠাৎ করে রাতে ১০০/২০০ লোক নিয়ে বাড়িতে হাজির হতেন খাওয়ানোর জন্য। যার ফলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তার মা প্রায়ই রাগারাগি করতেন।

সিরাজুর রহমানের বাবা জমিদার ছিলেন। ৪৫০ বিঘার জমি ছিল তাদের। জৈন্তাপুর উপজেলার মধ্যে তাঁর বাবা একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি নিজের জমিতে হেঁটে বাজারে যেতেন এবং বাড়িতে আসতেন। তখনকার সময় তাদের বাড়িতে ২০/২৫ জন কাজের লোক ছিল। যাদেরকে তাঁর বাবা নিজের জমিতে বাড়ি তৈরি করে আশ্রয় দিয়েছেন। বাড়িতে রান্নাঘরে চুলার আগুন নিভতো না, এতো মানুষদের প্রতিদিন আপ্যায়ন করা হতো। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং বাড়ির পালিত মুরগি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আপ্যায়ন করানো হয়। এ কথা রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনী শোনে তাদের বাড়িতে আক্রমণ করতে আসে। গোপন সূত্রে এই কথা শোনার পর তাঁর বাবা বাড়ির সবাইকে নিয়ে নিকট আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। 

সিরাজুর রহমানের বাবা জমিদার থাকায় লেখাপড়া করাতে আগ্রাহী ছিলেন সবাই। প্রায় সিরাজুর রহমানকে তার মা বলতেন জমি-জমা আছে। যা ঘরে বসে সারাজীবন খেলেও শেষ হবে না। তিনি বাবার সহযোগিতা ছাড়া অনেক কষ্টে লেখাপড়া করেন। তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিল কাদির, ফয়েজ, খছরু, অদুদ। তার মধ্যে কাদের মারা গেছে। আর ফয়েজ, খছরু আমেরিকায় এবং অদুদ লন্ডন থাকে। এদের সাথে এখন যোগাযোগ নেই। 

এই শিক্ষক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়ে ৮ দিন লাইফ সাপোর্ট ছিলেন। ৮ দিন পর হার্ট, কিডনি, লিভার কাজ করা শুরু করে। বাসাতে আনার পর প্রায় ৫ মাস ভালো  ছিলেন। গত ঈদুল আযহার পর আবার হৃদ রোগে আক্রান্ত হন। পর পর দুই বার হৃদ রোগে আক্রান্ত হন। সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনে ৩ বার ভর্তি ছিলেন। তিন সপ্তাহে তখন ২ লাখ টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়। 

পরে জমি বিক্রি করি ঢাকা যান তিনি। সেখানে ১০ লাখ নিয়ে যান। তখন চিকিৎসা বাবদ খরচ হয় সর্ব মোট সাড়ে ৭ লাখ। এছাড়া ২২ দিনে খাওয়া দাওয়াসহ অন্যান্য বাবদ ১ লাখ ব্যয় হ। এখন রিং বসানো লাগবে ৪ টা। প্রতিটা দেড় লাখ টাকা করে। মোট ৬ লাখ টাকা লাখ টাকা লাগে। কিন্তু পরিবারের কাছে তেমন অর্থ নেই। মাত্র তাদের হাতে আছে ২ লাখ টাকা। জমি অনেক ছিল রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অনেক সম্পত্তি ব্যাহত হয়।  ১০ বিঘার মত ছিল তাও চিকিৎসা খরচ হয়ে গেছে। জীবনের শেষ সময়ে এই শিক্ষক অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এই অভিভাবকতূল্য মানুষটির জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। 

গুনী এই শিক্ষক ২০২১ সালে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক বৃহত্তর সিলেটের বিয়াীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠািত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশনের জরিপে সিলেট সদর উপজেলার আদর্শ শিক্ষকের সন্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার পদকে ভুষিত হয়েছেন ।উল্লেখ্য ফাউন্ডেশন সিলেট জেলার বার উপজেলার ২৪ জন আদর্শ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে পদক দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের সুযোগ্য পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। পদকপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জন শিক্ষককে আর্থিক সহযোগিতাও দেবে সংস্হাটি ।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক এই গুণী শিক্ষক। আমরা তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।

user
user
Ad