`

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত: ফযিলত ও আমল

  • Views: 3258
  • Share:
মার্চ ২৩, ২০২১ ১৯:২৪ Asia/Dhaka

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর::বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের ধর্ম হলো ইসলাম। ইসলাম কেবল ধর্মের নাম নয় বরং পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ অনুসারীদের কাছে বছরের বেশ কয়েকটি দিন ও রাত রয়েছে যেগুলোকে তারা ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে। ফযিলতপূর্ণ রাতগুলোর মধ্যে শবে বরাত অন্যতম। সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ‘শবে বরাত’ কে ফযিলতপূর্ণ রাত বিবেচনা করে আবেগ উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ফযিলতপূর্ণ সারা রাত আমল করে থাকে। এ রাত্রির অনেক ফযিলত রয়েছে, কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক আমলের নির্দেশও রয়েছে।

আরবী মাসের শাবান মাসের চৌদ্দতম দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ‘শবে বরাত’ শব্দটি ফার্সিশব্দ। পবিত্র কুরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ্’ বা বরকতময় রজনী বলা হয়েছে। হাদীস শরীফে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ বা শা’বানের মধ্যরজনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাফসীরের কিতাব, হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থও ফিকাহ গ্রন্থসমূহে শবে বরাতের উল্লেখিত নাম ছাড়া আরো বিশেষ কিছু নাম এসেছে। যেমনঃ ‘লাইলাতুল কিসমাহ্’ বা ভাগ্যের রাত, ‘লাইলাতুত তাজবীয’ বা রিযিক বণ্টনের রাত, ‘লাইলাতুল ফায়সালাহ্’ বা তাকদীর নির্ধারণের রাত, ‘লাইলাতুল আফঊ’ বা ক্ষমার রাত, ‘লাইলাতুল কারামি’ বা দয়ার রাত, লাইলাতুত তাওবাহ্’ বা তাওবার রাত ও ‘লাইলাতুন্ নাদামাহ্’  বা মিনতির রাত।

শবে বরাতের ফযিলতঃ
পবিত্র কুরআনের বর্ণনাঃ পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে। (সুরা আদদুখান: আয়াত: ১-১০) । মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।

পবিত্র সুন্নাহর বর্ণনাঃ হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রজনীতে জাগরণ করে (ইবাদাত করে) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। সে রজনীগুলো হলো, জিলহজ্ব মাসের আট তারিখের রজনী, আরাফার রজনী, ঈদুল ফিতরের রজনী, ঈদুল আজহার রজনী, নেসফে শাবান বা শবে বরাতের রজনী। (আত-তারগীব ও ওয়াত-তারহীব: হাদিস: ১৫৮)। উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসকে যঈফ বলেছেন।

হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন রাসূল (সা.)-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাাহ, আমি আপনাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে এত অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে দেখিনি। রাসূল (সা.) বললেন, এটা ওই মাস যে মাস সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই গাফেল থাকে। এটা রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এটা এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমল আল্লাহ পাকের দরবারে পেশ করা হয়। আমার আকাঙক্ষা, আমার আমল আল্লাহর দরবারে এ অবস্থায় পেশ হোক যে আমি রোজাদার। (নাসায়ী, শুআবুল ঈমান)।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তার সন্ধানে) বের হলাম। এসে দেখলাম তিনি বাকী কবরস্থানে আছেন। তিনি বলেনঃ তুমি কি ভয় করছ আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার প্রতি কোন অবিচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমান করলাম আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকটে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মধ্য শা'বানে দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন। তারপর কালব গোত্রের বকরী পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদিস: ৭৩৯)। মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসকেও যইফ বলেছেন, উল্লেখ্য যে যঈফ হাদীস দ্বারা কোন বিষয়ে অকাট্য দলীল দেয়া যায় না। তবে এ হাদীস আমল যোগ্য। কোন সহীহ হাদীস পেলে এর আমল পরিতাজ্য। 

হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ-শা‘বানের রাতে (শা‘বানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত শবে বারাআতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৫৬৬৫/ সুনানে বাইহাকী–শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৩/ মু‘জামে তাবরানী, কাবীর, হাদীস নং ৩৫৪৩)।

হযরত আয়িশা বিনতে আবু বকর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাযে দাঁড়ালেন। তখন তিনি সিজদা এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তাঁর প্রাণ বিয়োগ হয়েছে। যখন আমি তা ভাবলাম, তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাতে তা নড়ে ওঠলো। তখন আমি ফিরে এলাম। এরপর যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনার প্রাণবিয়োগ হয়েছে। 

অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত শবে বারাআত)। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ-শাবানের রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। অতঃপর তিনি ক্ষমা প্রার্থনাকারীদেরকে ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদেরকে অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের বদকর্মেও কারণে ফিরিয়ে দেন।” (বাইহাকী-শুআবুল ঈমান)।

হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মধ্য-শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। কেউ আছে কি আপদগ্রস্ত? তাকে আমি নিষ্কৃতি দান করব। আছে কি এমুক, আছে কি ওমুক এভাবে আল্লাহ তা‘আলা আহবান চলতে থাকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত ।”(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৮)।

শবে বরাতের আমলঃ
মহান আল্লাহ পাকের নিকট প্রতিটি রাতই গুরুত্বপূর্ণ। বান্দার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু কিছু ফযিলতপূর্ণ রাত বান্দাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছেন, যেগুলোর আমল তাদের জন্য বেশ সৌভাগ্যের। প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম শবে বরাতের আমলের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কিংবা ছাড়াছাড়ি না করে স্বাভাবিক আমল জারি রাখার তাগিদ দিয়েছেন। তাঁদের মতে আমল সকল অবস্থায় করা যায়, কাজেই কোথাও যদি সহীহ হাদিস না থাকে সে ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসের সমর্থন পেলে সে অনুযায়ী আমল করা যেতে পারে। 

মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম বিশেষ রজনীসমুহে যে সকল আমল করার জন্য মুসল্লিদেরকে উৎসাহ দেন সেগুলো হল:
১. নফল নামাযঃ মহিমান্বিত এ রজনীতে বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা। কেননা হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। অপর হাদিসে এসেছে, এক সাহাবি প্রশ্ন করেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কী? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সিজদা করবে (বেশি বেশি নফল নামাজ পড়বে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করো তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।’ (সহিহ মুসলিম : হাদিস: ৩৫৩)।

২. যিকির আযকারঃ ফযিলতপূর্ণ এ রজনীতে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। চাই সেটি ব্যক্তিগতভাবে হোক কিংবা সামষ্টিক ভাবে হোক। তবে একান্তে সংগোপনের যিকির আল্লাহর নিকট অত্যধিক পছন্দনীয়। 
 অল্লাহপাক বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে,  জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তিপায়।’ (সুরা রাদ: আয়াত: ২৮)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (বুখারী: হাদিস: ৬০৪৪)। একবার হযরত মুআজ বিন জাবাল রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.) সর্বোত্তম আমল কোনটি? রসুল (সা.) বললেন ‘মৃর্ত্যুর সময় যেন তোমার জিহŸা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত থাকে।’ (মুজামুল কাবীর : হাদিস: ১৮১)।

৩. কুরআন মাজীদ তেলাওয়াতঃ এ মোবারক রাত্রিতে বেশি বেশি তেলাওয়াত করা। কেননা তেলাওয়াত মানুষের ঈমানকে বৃদ্ধি ও সুদৃঢ় করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘যখন তাদের প্রতি কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ইমান বাড়িয়ে দেয়।’ (সুরা আনফাল: আয়াত: ২)। হাদিস শরীফে  এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর তেলাওয়াত করল তার বিনিময়ে সে একটি নেকী পাবে, আর একটি নেকীর বদলা হবে দশগুণ, একথা বলছি না যে, আলিফ-লাম-মীম, একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। (সুনানে তিরমিযী: হাদিস: ২৯১০)। অপর বর্ণনায় ‘তামিমুদ্দারী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে এক’শ আয়াত তেলাওয়াত করবে সে সম্পূর্ণ রাত জাগরণকারী হিসেবে গণ্য হবে।’ (সুনান আদ্ দারেমী: হাদিস: ১৬৯৫৮)।

৪. দুরুদ শরীফ পাঠঃ ফযিলতপূর্ণ এ রাতে রাসুল (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দুরুদ পাঠ করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি সালাত প্রেরণ করেন। হে মুমিনরা! তোমরাও তাঁর প্রতি যথাযথ সালাত ও সালাম পেশ করো।’ (সুরা আহজাব: আয়াত : ৫৬)। হাদিস শরীফে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ১০টি রহমত বর্ষণ করেন।’ (মুসলিম: হাদিস : ৯২১)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কাছে অতি উত্তম হবে ওই ব্যক্তি, যে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে। (জামে তিরমিজি: হাদিস: ৪৮৪)।

৫. তাওবা ইস্তেগফারঃ জীবনের ছোট বড় সকল গুনাহ মোছনের জন্য এ রাত্রিতে বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করা। আল্লাহপাক বলেন, (হে নবী,) তুমি বলে দাও, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। (সূরা যুমার: আয়াত: ৫৩)।  রাসুল (সা.) বলেন, হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কছে তওবা করো। আমি তো তাঁর কাছে দৈনিক একশ বার তওবা করি। (সহীহ মুসলিম: হাদীস: ২৭০২)। তিনি তাঁর উম্মতদেরকে তাওবা ইস্তেগফারের আমল প্রসঙ্গে বলেন তোমরা এ ভাবে বলবে, ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি মহা ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন। সুতরাং আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। (সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদীস: ৩৮৫০)।
 
৬. কবর যিয়ারত করাঃ এ রাত্রির বিশেষ আমল হলো পিতামাতা, নিকটতম আত্মীয় স্বজন ও সকল মুসলিমের মাগফেরাত এর লক্ষ্যে কবর যেয়ারত করা। কবর যিয়ারত করা সুন্নাত। এটি মৃত্যু ও আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'আমি তোমাদের এর আগে কবর যিয়ারতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে কবর যিয়ারত করো। কেননা তা দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখেরাতের স্মরণ করিয়ে দেয়'। (সুনানে ইবনে মাজাহ : হাদিস: ১৫৭১)।

৭. কায়োমনবাক্যে দোয়া করাঃ এ রাত্রির বিশেষ আমল হলো, সকল গুনাহ মার্জনা, সফলতা লাভ, সমস্যার সমাধান সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য দোয়া করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব, যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হবে। (সুরা মু’মিন: আয়াত: ৬০)। রাসুল (সা.) বলেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি: হাদিস: ৩৩৭৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোনো মুসলমান দোয়া করে, যদি তার দোয়ায় গুনাহের কাজ কিংবা সম্পর্কচ্ছেদের আবেদন না থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তিনটি প্রতিদানের যেকোনো একটি অবশ্যই দান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দোয়া কবুল করেন এবং তার কাক্সিক্ষত জিনিস দিয়ে দেন। দোয়ার কারণে কোনো অকল্যাণ বা বিপদ থেকে হেফাজত করেন। তার আখিরাতের কল্যাণের জন্য তা জমা করে রাখেন।’ (আহমাদ: হাদিস: ১১১৪৯)।

৮. দান সদকা করাঃ ফযিলতের এ রাত্রিতে বেশি বেশি দান সদকা করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘যদি তোমরা দান প্রকাশ্যে করো, তবে তা উত্তম; আর যদি তা গোপনে করো এবং অভাবীদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য শ্রেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সুরা বাকারা: আয়াত: ২৭১)। হাদিস শরীফে এসছে, নবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হচ্ছে, ‘এক ব্যক্তি এত গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে বাম হাত জানতেই পারে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

৯. জীবিত পিতামাতা থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া মৃতদের জন্য ঈসালে সাওয়াব করাঃ এ ফযিলতের রাত্রিতে পিতামাতার নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া, তাঁদের জন্য দোয়া করা। দোয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,  ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না ’ (সূরা নুহ: আয়াত: ২৮)। তিনি আরো বলেন, ‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সূরা বানী ইসরাঈল: আয়াত: ২৪)।

১০. তাকওয়া অবলম্বনের শপথ নেয়াঃ এ রাত্রির সবচেয়ে বড় আমল হলো জীবনে সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া অবলম্বনের জন্য শপথ গ্রহণ করা। সকল পাপাচারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে সর্বদা নেক কাজে নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।

আল্লাহপাক আমাদেরকে শবে রবাতের ফযিলতের মর্ম বুঝার এবং বর্ণিত বিষয়সমুহে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ  মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।

user
user
Ad