`

সিলেটি মজার মজার প্রবাদ-প্রবচন ও এর ব্যাখ্যা

  • Views: 13008
  • Share:
অক্টোবার ৯, ২০২০ ১২:২৭ Asia/Dhaka

সিলেটের প্রবাদ প্রবচনে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য। প্রবাদ-প্রবচন কে সিলেটীরা আঞ্চলিক ভাষায় ডাকের কথা, ছড়াকাটা, সিল্লক ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকে। এ সব প্রবাদ-প্রবচন সিলেটের গ্রামাঞ্চলেই বেশী প্রচলিত। সিলেটের আঞ্চলিক প্রবাদ-প্রবচন মুখে বলা যত সহজ, লিখতে গেলে তা কিন্তু সহজ নয়-বেশ কঠিনই মনে হয়।

আধুনিকতা, শহরকেন্দ্রিকতাসহ আরও বিভিন্ন কারনে সিলেটের এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে আছে। যাক, এখানে সিলেট অঞ্চলের কতিপয় প্রবাদ-প্রবচনের উল্লেখ করা হল। 
১. ভালা মাইন্সর (ভদ্রলোকের) জুতা বইও (বহন করিও), কমিন্দর (দুর্জনের) পাগড়ীও না।
 - দুর্জনের সংস্রব পরিত্যাজ্য
২. আল্ (হাল) নাই বেটায় ভুঁই জুড়ে, দাঁত নাই বেটিয়ে হুকইন। (শুটকি) পুড়ে।
  - যে যেটার জন্য উপযুক্ত নয়, সে সেটার জন্য অনাবশ্যক চেষ্টা করে থাকে
৩. ধরা বান্ধার হাই (জোর-জবরদস্তি করে বরের অমতে বিয়ে), রাইত পোয়াইতে নাই 
  - জোর-জবরদস্তি করে কাউকে কোন কাজ করাতে গেলে বিপত্তি ঘটে
৪. নিজর কাপ্‌ড়ে (শাড়ীতে) হেঙ্গা বওয়া (বিয়ে করা)
  -  অতি আগ্রহী হয়ে যেচে গিয়ে অযাচিতভাবে কোন কিছুতে নিজেকে জড়ানো
৫. ফেন্‌ (ভাতের মাড়) দিয়া ভাত খাইয়া , গপ্ মারে দই
  - আত্মতুষ্টি সাধনে অতিরঞ্জিতভাবে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়াস
৬. চোরে চোরে আলি (বন্ধুত্ব), এক চোরে বিয়া করইন্ আরক্ চোরর্ হালি (শালিকা)
  -  চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
৭. ভাত খাও হাইঅর (স্বামীর), আর ক্কাউয়া (কাক) ডাকাও লাঙ্গরর
  - আপন-জনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে আপনজনকে অবজ্ঞা করে অপরজনের তুষ্টি সাধনে সদা তৎপর
৮. চেঙ্গও (টাকি মাছ) উজাইন, বেঙ্গও (ব্যাঙ) উজাইন, খইয়া (খলসা) পুঁটি তাইনও উজাইন
  - যোগ্যজনের সঙ্গে অযোগ্যজন তাল দিয়ে আষ্ফালন করা
৯. ছাগিয়ে চেনাইতে (মুত্র ত্যাগের সময়) ধরইন্ না, পরে তিন বন্দ (মাঠ) দৌড়াইন্
  - উপযুক্ত সময়ে কর্ম তৎপর না হলে অসময়ে কর্মতৎপর হলে বেশ বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়
১০. দা'র বালি, কুড়ালর হিল (শিল), বান্দীর লাত, গোলামর কিল
  - অধ:স্তনদের যুৎসই শাসনে রাখার দরকার আছে 
১১. চোরের মা'র বড় গলা, আর মাগে দুধ আর কলা
  - অপরাধীর পক্ষ নিয়ে গলাবাজি করে অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস
১২. চরে (দ্বারে দ্বারে ঘোরে) ফকির মরে না
  - অলসভাবে বসে না থেকে পরিশ্রম করলে সুফল পাওয়া যায়
১৩. মাউগোর (স্ত্রীর) কথা চলবায়, আগন (অগ্রহায়ন) মাসে হকি (ফকির) অইবায়
  - স্ত্রীর কু পরামর্শে চললে কপালে দু:খ আছে
১৪. কার গরু, কে ধুমা (ধোয়া) দেয়
  - নির্ধারিত দায়িত্ব ছাড়া কেউ কাজ করতে চায় না)
১৫. বাড়ি কান্দার (নিকটের) কুত্তায়ও বেউকায় (ঘেউ ঘেউ করে)
  - নিজ বাসস্থানে থেকে নিজেকে শক্তিশালী ভেবে হম্বি দম্বি করা 
১৬. তোরও বালি, মোরও বালি
-উভয়ের জন্য সম অবস্থা বিরাজমান অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ।
১৭. খালি দোয়ায় পোয়া (পুত্র সন্তান) অয়না, তনাইর (শরীরের) জোরও লাগে
-দোয়ার সাথে চেষ্টা তদবির ও পরিশ্রম প্রয়োজন ।
১৮. হুরু (ছোট) পোয়া, বড় পোয়ার বাপ
-ইচঁড়ে পাকা।
১৯ আগিয়া হছইননা (মল ত্যাগ করে পানি দিয়ে পরিষ্কার না করে), পাদিয়া (বায়ূ ত্যাগ করে) যাইনগি গলা পানিত্‌
-অত্যাবশ্যক কাজে তৎপর না হয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজে অতিতৎপর হওয়া।
২০. মাতিলে মাত্‌রা (বাঁচাল) না মাতিলে আবরা (বোবা)
-কথা বললে বাঁচাল, আবার না বললে বোবা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
২১. নয়া যোগী তাতো (আসনে) উঠ্‌ছইন
-ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে হঠাৎ করে বৃহ্ত্তর অবস্থানে এসে অহংকারভরে আষ্ফালন করা।
২২. দশ্‌র মুখো হাখরাইদ্‌ (সংক্রান্তি)
-দশ চক্রে ভগবানভূত ।
২৩. ঘাইল (ধান ভানার কাঠের তৈরী জিনিস) আন্‌মান্‌ (উপযুক্ত) ছিয়া (ধান ভানার জন্য কাঠের তৈরী শক্ত দন্ড যার অগ্রভাগে লোহার রিং থাকে ), জাতে জাতে বিয়া
-সমগোত্রের মধ্যে সম্মিলন।
২৪. ঘরো নাই ঘটি লোটা, কোম্‌রো বান্ধা চাবির ঝুটা
-অপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রদর্শন করে অহমিকা প্রকাশ।
২৫ কুত্তায় বাচ্চা করে, হিয়ালর (শিয়ালের) পেট ভরে
-একজনের পরিশ্রমের ফসল অন্যজন ভোগ করে।
২৬. হম্‌কে (সামনাসামনি) পড়লে ভাইভাই, আফরকে (অগোচরে) হালা (গালি অর্থে)
-সামনা-সামনি দেখা হলে যেন বন্ধু, পরোক্ষে কিন্তু শত্রু।
২৭. কার গরু, কে ধুমা (ধোঁয়া) দেয়
-নির্ধারিত দায়িত্ব ছাড়া কেউ কাজ করতে চায় না
২৮. আউওয়া (বোকা) চাড়াল (চন্ডাল) ভুকাডুম, হারা রাইতে (সারা রাতে) এক ঘুম
-দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি
২৯. আতো (হাতে) বৈটা, ঘাটো নাও
-শেষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুত।
৩০. হইয়ে (শেষ পর্যন্ত) আইলায়, বুনাইরে (ভগ্নিপতি) আরাইয়া (হারায়ে)
-অসময়ে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন।
৩১. মাইনষ্‌র কুটুম আওয়া-যাওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ়তর হয় ।
-পারস্পরিক আসা-যাওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ়তর হয়।
৩২. কম আক্‌লে (বুদ্ধিতে) তরে (পার পেয়ে যায়), বেশী আক্‌লে মরে
-অতি চালাকের গলায় দড়ি ।
৩৩. যার লগে (সঙে) যার মজে মন, বিট্‌ (বিষ্টা) অইলেও চন্দন
-প্রেম অন্ধ ।
৩৪. যার বিয়া তার খবর নাই, আরি পরির (পাড়া প্রতিবেশীর) ঘুম নাই
-যার কাজ সে কিন্তু নির্বিকার, অন্যদের তাগিদ বেশী।
৩৫. ইজ্জত যায় না ধুইলে, খাইসলত্‌ (অভ্যাস) যায় না মইলে (মরলে)
-কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না ।
৩৬. ঈদর চান (চাঁদ) না মক্কার তেতই (তেতুল), অতদিন আছলায় কই
-বহুদিন পরে দেখা হলে মনের অভিব্যক্তির প্রকাশ ভঙ্গি ।
৩৭. অমৃতর মা'র মুখখানি মিটা, হারা দিন (সারাদিন) কাম করাইয়া দেয় আধখানি (অর্ধেক) পিঠা
-মিষ্টি কথায় কাজ করায়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেয়া।
৩৮. উচার উচ্‌, নীচর নিচ্‌, মা দেখি ঝি (কনে) আনিছ
-ভাল বংশের মেয়ে বিয়ে করা উত্তম।
৩৯. আতুর বিবি চতুর অইলা, ব লার (বোলতার) কামড় খাইয়া
-বিপদে পড়লে অলসও পরিশ্রমী হতে বাধ্য।
৪০. লউ (রক্ত) কাটলে দু'ফাঁক (ছিন্ন) অয়্‌ না
-রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না ।
৪১. উদান (সকাল) মাদান (মধ্যাহ্ন) বাছিয়া, কাম কর নাছিয়া
-সময় বুঝে সঠিক কাজ করা।
৪২. উরাত (উরু) দেখাইয়া বরমপুত্র (ব্রহ্মপুত্র নদ )পার
-প্রলোভন দেখায়ে কাজ উদ্ধার।
৪৩. মাইর (মায়ের) ঘরে থাকা, আর হাইরর (স্বামীর) ঘর করা এক না
-স্বামীর সংসারে একজন রমণীকে বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেল করে নিজেকে খাপ-খাইয়ে নিতে হয়।
৪৪. হাজ্‌মা পুয়ার (সদ্যজান সন্তানের) মাথায় ভরন (গাছ গাছড়ার পাতা দিয়ে তৈরী ঔষধের প্রলেপ) দেওয়া বালা নায়
-তাড়াহুড়া করে সব কিছু বিবেচনা না করে দ্রুত প্রাপ্তির নিমিত্তে কাজ করলে প্রাপ্তির তুলনায় বিপর্যয়ই ঘটে।

user
user
Ad