কুরবানির শর্ত ও নিয়মাবলী

জুলাই ১৩, ২০২১ ১৪:৫১ Asia/Dhaka

এইচ.এম.ফখরুল ইসলাম সিদ্দিকী:: আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জনের জন্য ঈদুল আজহার দিন থেকে কুরবানির দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু জবেহ করাই হচ্ছে কুরবানি। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ। যা কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন মাজিদে এসেছে- ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কুরবানি কর।’ (সুরা কাউসার :আয়াত -২)

কুরবানি যাদের জন্য ওয়াজিবঃ
১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর কাছে যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব  পরিমাণ (৭.৫ তোলা/ভরি সোনা অথবা ৫২.৫ তোলা/ভরি রূপা বা সমমূল্য) সম্পদ থাকে তবে তার কুরবানি করা ওয়াজিব।উক্ত সম্পদ এক বছর কাল থাকা আবশ্যক নয়।
টাকা-পয়সা, সোনা-রূপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়োজনী আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

কুরবানির শর্তাবলিঃ
কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য শরীয়ত নির্ধারিত কিছু শর্ত রয়েছে আর তাহলো-

কুরবানির পশুঃ
এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেনী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা।এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আন‘আম।’ যেমন এরশাদ হয়েছে- 
وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ 
‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদাযের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ [সূরা হজ্জ্ব(২২):৩৪]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কুরবানি করেননি ও কুরবানি করতে বলেননি। তাই কুরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।

কুরবানির পশুর বয়সঃ
কুরবানির পশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। আর তাহলো-
  * উট : পাঁচ বছরের হতে হবে।
  * গরু, মহিষ : দুই বছরের হতে হবে।
  * ছাগল, ভেড়া, দুম্বা : এক বছর বয়সের হতে হবে।

কুরবানির পশুর পরিপূর্ণ মালিকানা থাকাঃ
কুরবানি দাতা যে পশুটি কুরবানি করবেন, তার উপর কুরবানি দাতার পরিপূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। যদি এ পশু বন্ধকের পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু হয় তবে তা দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না।

কুরবানীতে শরীক হওয়াঃ
অংশীদারির ভিত্তিতে কুরবানী কারাকে ‘ভাগে কুরবানী দেয়া’ বলা হয়। ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা একজনের পক্ষ থেকে একটা পশু কুরবানী করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের নামে সাতটি কুরবানী করা যাবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
জাবির (রা.) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে হজ্জ ও উমরার সফরে সাথী ছিলাম।..... তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম। (সহীহ মুসলিম, হা/১৩১৮)

কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবেঃ
কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে-
عن البراء بن عازب رضى الله عليه وسلم قال: « قام فينا رسول الله صلى الله وسلم فقال:أربع لا تجوز في الأضاحي العوراء البين عورها والمريضة البين مرضها والعرجاء البين ضلعها والكسيرة التي لا تنقى 
সাহাবী বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন : চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। নাসাঈ‘র বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে। (তিরমিজি-১৫৪৬; নাসাঈ’-৪৩৭১; আবূদাউদ; হাদিসটি সহীহ)।

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।’ (মুগনী, ১৩/৩৬৯)

কুরবানীর পশু যবেহ করার নিয়মাবলিঃ
কুরবানীদাতা নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করবেন, যদি তিনি ভালোভাবে যবেহ করতে পারেন। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে যবেহ করেছেন। আর যবেহ করা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম । তাই প্রত্যেকের নিজের কুরবানী নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।

যবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়ঃ
 * পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা।
 * এমন ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে।
 * যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা করা হয় এবং তা খুবই শীঘ্রতা ও শক্তির সাথে যবেহ স্থলে (গলায়) পোঁচানো হয়।
 * বধ্য পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মাকরূহ)।
 * ‘যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে।’
 * একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে যবেহ করা এবং ছেচরে যবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরূহ।

কুরবানীর গোশত বন্টননীতিঃ
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন- 
فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡبَآئِسَ ٱلۡفَقِير 
অর্থ-‘অত:পর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাব গ্রস্থকে আহার করাও।’ [সূরা হজ্জ্ব,:২৮]

রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেছেন-
كلوا وأطعموا وادخروا
‘তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।’ (বুখারী, হাদীস নং ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭১)

‘আহার করাও’ বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্থকে দান করা ও ধনীদের উপহার হিসেবে দেয়াকে বুঝায়। কতটুকু নিজেরা খাবে, কতটুকু দান করবে আর কতটুকু উপহার হিসেবে প্রদান করবে এব পরিমাণ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও হাদিসে কিছু বলা হয়নি। তাই উলামায়ে কেরাম বলেছে, ‘কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ দরিদ্রদের দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা মুস্তাহাব (উত্তম)। কেউ চাইলে সে তার কুরবানীর সম্পূর্ণ গোশতকে বিতরণ করে দিতে পাবে।

কুরবানীর গোশত সংরক্ষণঃ
কুরবানীর গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। অতএব, উল্লেখিত শর্ত ও নিয়ম মেনে কুরবানি করা প্রত্যেক মুমিনের  একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।

হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনে কুরবানির পশু কেনার ও কুরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখকঃ
 মাওলানা এইচ.এম.ফখরুল ইসলাম সিদ্দিকী.
সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা),
সাদিপুর অদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়,
উপজেলা-ওসমানীনগর,
জেলা-সিলেট।

লেখাটি শেয়ার করে অন্যকে জানার সুযোগ করেদিন; ইনশাআল্লাহ্ তাতে আপনিও সাদাকায়ে জারিয়া সাওয়াব লাভ করবেন।

সূত্রঃ- মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন, হাদিস সাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ইলমুল ফিকহের বিভিন্ন গ্রন্থ সমূহ ও ইসলামী স্কলারবৃন্দের বিভিন্ন লেখা/কলাম/প্রবন্ধ থেকে সংগ্রিহীত।